থিসিস-সিনথিসিস-এন্টিথিসিস


জ্ঞান অভিজ্ঞতা থেকে আসে যেখানে নিয়ামক থাকে কিছু সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক চলক। এগুলোর মূর্ত প্রতিফলন মানব চরিত্রের একটি রূপরেখা দান করে জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোকে গতিশীল করে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের সবথেকে বড় প্রব্লেম এদের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি কখনো রাশিয়া, কখনো পশ্চিম, কখনো চীন কিংবা অন্যকোনো ভাবাদর্শ প্রভাবিত। এখানে নতুনকে গ্রহণ করার ঔদার্য খুব কমের আছে। যে বেটা চাইনিজ আদর্শিক সে অন্য কিছু দেখলেই চিহিঁ টগবগ করে তেড়ে আসে। রাশিয়ান বেটা শুধু ঐ লেলিন মার্ক্সই জানে, নিজেকে ঐ বিষয়ের মহা পন্ডিত ভাবে। ভিন্ন কিছু বলতে গেলে ঘোৎ ঘোৎ করে গুঁতো মার্তে আসে। পশ্চিমা তাত্ত্বিক ঘরানা প্রভাবিত মানুষদের কাছে যখন আপনি পোস্ট কলোনিয়াল কাউন্টার ডিসকোর্স জাতীয় কিছু তুলে ধরতে যাবেন যে বলবে ফেনাটিক, রেশনাল কিংবা ন্যাশনালিস্ট। তাইতো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নিয়ে কথা বলতে গেলেই আপনি ট্যাগ খাবেন বিশেষ রাজনৈতিক দলের। কিন্তু সংবিধান লঙ্ঘন করে বার বার দুই বাংলাকে তালগোল পাকিয়ে একটি বিশেষ শব্দ উপস্থাপন করলে দোষ নাই। আপনি সবাইকে জোর করে বাঙালি বানাবেন। এক্ষেত্রে যখন বিশেষ সংস্কৃতির অধিকারী জাতিগোষ্ঠী প্রান্তিক হয়ে যাবে সেক্ষেত্রে আপনি বলবেন ওরা আদিবাসী। আপনার উক্তি কিভাবে স্বাধীন বাংলাদেশী জাতিসত্তাকে নাই করে দিচ্ছে যেটাও ধর্তব্যের বাইরে থাকে।

সংখ্যালঘু নিয়ে যতো চুলকানি মার্কা কথা বলতে পারবেন আপনি ততোই পদে উঠবেন। এই সংখ্যা লঘু যদি হয় তথাকথিত নন সেমেটিক কেউ তাইলে তো সব মিলিয়ে আপনার পোয়াবারো। কিন্তু যখন নিজদেশে পরবাসী ঐ ফিলিস্তিনি অসহায় মানুষগুলোর অধিকারের কথা বলবেন, যখন বলবেন ইরাকের মানুষগুলোর কথা কিংবা আরব বসন্তের বলি হয় সাধারণ মানুষ খালেদ সাইদের মতো কারো মায়ের কান্না আর হাহাকারের কথা। তখন আপনি গালি খাবেন মৌলবাদী বলে। আপনি দুর্দান্ত ক্যাথলিক ভাবাদর্শ বুখে ধরে ধর্ষকামী উন্মাদনায় ঝাপিয়ে পড়ে মানুষ হত্যা করেন কোনো সমস্যা নাই।আপনি পোপতন্ত্রের বিরুদ্ধে কিছু বলা তো দূরে থাক কেবল আংগুল তুলেন। চামচিকার দল আপনাকে সরাসরি প্রোটেস্ট্যান্ট বানাবে। আপনি লেনিন-মার্ক্সকে খাওয়ার প্লেট থেকে থেকে টয়লেট, কুলকুচি করার বেসিন থেকে বাথটাব কিংবা কমোড সবখানে নিয়ে যান সমস্যা নাই, আপনি প্রগতিবাদী।

 

আপনি সাইদের ডিসকোর্স কিংবা দেরিদার অবিনির্মাণ নিয়ে কোনো রুশ-ওয়েস্টার্ন-মার্ক্সিস্ট-ফেমিনিস্ট ফান্ডামেন্টালিজমের প্রতিবাদ করেন আপনি ট্যাগ খাবেন ফান্ডামেন্টাল বায়াসড বাম হিসেবে। তাই ঐ একটা কথাই প্রযোজ্য সবখানে তা হচ্ছে জ্ঞান ঐ শ্রেণির ক্ষমতাকে বৈধতা দিচ্ছে, যা নতুন জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করেছ। ঐ জ্ঞানতাত্তিক কাঠামো এক একটি নিত্য নতুন পাটাতন দিচ্ছে যার উপর ভর করে নতুন নতুন জ্ঞান উৎপাদিত হচ্ছে যেগুলো নির্দিষ্ট শক্তিই হালাল করে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে একটি জ্ঞান জায়েজ হয়ে ওঠা কিংবা হারাম হওয়ার ক্ষেত্রে ফ্যাক্ট কিংবা ফিকশের কোনো দ্বৈততা নেই। শুধু জ্ঞানতাত্ত্বিক পাটাতনের উপর ভিত্তি করে যে অনুরণ তৈরি করে বিশেষ গোষ্ঠী তাই বৈধ। ভিন্নমত, যদি তা ধ্রব সত্যও হয় প্রচারের প্রাদপ্রদীপ থেকে ছন্দপতন ঘটায় তা হবে অবাঞ্ছিত।

 

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ধারায় অশিষ্টায়নজনিত ছন্দপতনের সমালোচনা করা প্রত্নতত্বের সামান্য শিক্ষার্থীর পক্ষে মানায় না। কিংবা প্রগতির যুগে থেকে গুস্তাফ কোসিনার প্রত্নতত্ত্ব চর্চাকে উপনিবেশিকায়নের চূড়ান্ত ধাপ কিভাবে বলতে পারি যার সাথে ব্যুহলার বা জন লূবকের কোনো পার্থক্যই নাই। এগুলোর উত্তর দিতে চেষ্টাই করিনি। জ্ঞান-ক্ষমতা নিয়ে মিশেল ফুঁকোর বুজরুকি আমার চিন্তাকাঠামোতে কোনো রেখাপাত করতে পারেনি। তেমনি সবথেকে প্রিয় সাবঅল্টার্ন ইতিহাস চর্চার সমালোচনা করতে চেয়েছি কেনো এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নেই। বিশ্বনন্দিত রবি ঠাকুরকে পড়ার তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলে কিভাবে অখ্যাত আবুল হাসান কিংবা রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে সবথেকে প্রিয় কবির স্থান দিয়েছি সাথে পড়ার তালিকাতে ঠিকই রেখেছি সুকান্ত, নজরুল, জীবনানন্দ কিংবা পল্লীকবি জসীম উদ্দিনকে সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। তাইতো জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল কিংবা মোড়ল ঔপন্যাসিক এমদাদুল হক মিলন আমার মনে রেখাপাত করতে পারেনা। কিন্তু তুলনামূলক অপরিচিতি শহীদুল জহিরকে ঠিকই প্রিয় তালিকায় রেখেছি। সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন প্রজম্নের মাহবুব ময়ুখ রিশাদ, হাসান মাহবুব কিংবা সকায় রায়ের মতো আন্তর্জালিক লেখক।

 

একজন পরিপূর্ণ ধর্মবিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও আমি কিভাবে হুমায়ুন আজাদের লেখার ভক্ত হয়েছিলাম এই প্রশ্ন অনেকেই করেছেন। তেমনি আমি কিভাবে কার্ল মার্ক্সের ঘোর বিরোধী হয়েছি। কিভাবে জাকা লাকা কিংবা ফ্রানৎস ফ্রানো বা জ্যঁ বদ্রিয়ারকে অন্য চোখে দেখতে পারি এগুলো তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে বার বার। অনেকে ক্রোধ সংবরণ করে বলতে চেয়েছেন এগুলো কথা কথা নয়। আর সবার উপরে হচ্ছে কথা আর তত্ত্বকথা এক নয়। কিন্তু আমি মনে করি সবকিছুর থিসিস, এন্টিথিসিস কিংবা সিনথিসিস আছে। থিসিস করার জ্ঞানতাত্ত্বিক অধিকার প্রতিটি মানুষেরই আছে। তেমনি যে কেউ চাইলেই একটি বিষয়ের সিনথিসিস করতে পারেন। চাইকি তা যে কারো অপছন্দসই কিংবা নিতান্ত অমূলক হলেও। এখানে আমি বলবো সিনথিসিস করাটা কারো জ্ঞানতাত্ত্বিক অধিকারের মৌলিকত্বের মধ্যে পড়ে। পরিশেষে আসছি এন্টিথিসিস পাটটিতে এখানেও অন্যথা ঘটবার নয়। তাই বলে একটি মানুষের জ্ঞানতাত্ত্বিক মুক্তচিন্তার পথে বিন্ধাপর্বত হয়ে দাড়ানোর কোনো অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি। আর এখানে কাউকে ট্যাগিং করা, বিশেষ শ্রেণিভুক্ত করা আর গালিগালাজ করা এগুলো কি চিহ্নিত করে ?

আমি ট্যাগকারী এই সকল দ্বিলেজী শুক্রজাত আদম সন্তানের জন্য কেবল করুণার কথাই মনে করছি। এরা নিজেরা নিজেদের সম্পর্কে জানেনা। অডিপউজের লৌকিক অনুরণনে এরা আজ অন্ধপ্রায়। কামসূত্র আর পর্ণগ্রাফিকে ঘোলপাকিয়ে এরা লৌকিকতার গন্ধ খুজতে চায় যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে। মনে করে সেখানেই নাকি ভিনসেন্ট ভ্যাগগগের অভিব্যক্তিবাদ গগ গগ করে উগলে দিচ্ছে।আফসুস!!

মন্তব্য করুন