
ফুলকি, টিক্কি, পানি কে পাতাসে, ফুচকা, গুপচুপ, পানিপুরি কিংবা পাকোড়ি, যা-ই বলা হোক না কেন, সারা ভারতবর্ষে জনপ্রিয় একটি খাবার এ ফুচকা। ফুচকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রচলিত নাম পানিপুরি, যার উদ্ভব হয়েছিল দক্ষিণ বিহারের মগধে। প্রথম দিকে ফুলকি নামে পরিচিত এই খাবার সম্পর্কে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক জার্নাল অব ইন্ডিয়া বিশদ বিবরণ দিয়েছে। ওই বিবরণে এ খাবারের উত্পত্তিস্থল হিসেবে অবশ্য বারানসির কথা বলা হয়েছে। ভারতের অনেক জনপ্রিয় খাবার লুচির ক্ষুদ্র সংস্করণকে শক্ত কুড়মুড়ে করে খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে মোগলাই খানার সংস্পর্শে এসে এর গাঠনিক আঙ্গিকে পরিবর্তন আনে ভারতীয়রা। সাধারণ শক্ত লুচি পরিণত হয় মসলাদার-রসাল গোলগাপ্পা তথা পানিপুরিতে, যা আমাদের দেশে ফুচকা নামে পরিচিত।
১৯৪৭-এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ অঞ্চলে ফুচকা ততটা জনপ্রিয় হতে পারেনি। এ অঞ্চলের কেউ ফুচকা জাতীয় খাবার খেলে তাদের সরাসরি ‘ঘটি’ কিংবা ‘কেইশো’ নামে উপহাস করা হতো। তবে ভারত-পাকিস্তান আলাদা হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের অনেক অধিবাসী এ দেশে চলে এসে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। তাদের সংস্পর্শে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এ পানিপুরি তথা ফুচকা আজ বাংলাদেশীদের বিনোদনেরও উপলক্ষ হয়ে উঠেছে। মরুভূমি অঞ্চল রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশে পাতাসি নামে পরিচিত এ খাবারকে তামিলনাড়ুতে পানিপুরি নামে ডাকা হয়। তবে পাকিস্তান, নয়াদিল্লি, জম্মু-কাশ্মীর, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্য প্রদেশ ও হিমাচল প্রদেশে এর নাম গোলগাপ্পা। তেলেঙ্গানা, উড়িষ্যা, ছত্তিশগড়, হায়দরাবাদের অনেক অঞ্চলে একে ডাকা হয় গুপচুপ নামে। কিন্তু নেপালে এ খাবার জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ফুলকি নামে, যার সঙ্গে উত্পত্তিস্থল মগধে প্রচলিত নামের মিল রয়েছে।
আমরা জানি, দক্ষিণ এশিয়া বিখ্যাত তার সুন্দর-রুচিশীল মসলা জাতীয় খাবার আর ঝালসমৃদ্ধ ডিশগুলোর জন্য। তাই ফুচকাকে একান্ত দক্ষিণ এশীয় ডিশ হিসেবে ধরে নিলে পুরোপুরি ভুল হবে না। তবে এর ফুচকা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার ইতিহাসটাকে একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বিশেষত মোগল আগমণের পর থেকে এদেশীয় খানাপিনায় আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়। হিন্দু ব্রাহ্মণদের সেই সনাতনী খাদ্যরীতি বদলে যাচ্ছিল বলে তারা মনের আক্রোশে একটি প্রবাদের প্রচলন করে বসেন ‘পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে।’
অঞ্চলভেদে নামকরণের ভিন্নতার পাশাপাশি এর পরিবেশনের পদ্ধতিতেও ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে এর পুর ঢোকানোর আধার তৈরিতে যে আটার খামির তৈরি করা হয়, সেখানে অঞ্চলভেদে বৈচিত্র্য রয়েছে। আর মূল পার্থক্যটি লক্ষ করা যায় পুর তৈরিতে। কোনো কোনো এলাকায় ঝালের পরিবর্তে মিষ্টিজাতীয় পুর ব্যবহার করা হয়, অনেক সময় ফুচকার সব উপকরণ দেয়ার পর দই দিয়ে পরিবেশন করতে দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে সব ঠিক থাকে, কেবল তেঁতুলজলের পরিবর্তে দেখা যায় ধনিয়া পাতার চাটনি কিংবা পুদিনা মিশ্রিত জল। অধিকাংশ কট্টরপন্থী ব্রাহ্মণের আবাসস্থল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আমিষের মতো পেঁয়াজ-রসুনে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই এখানে ফুচকার পুর হিসেবে আলুতে পেঁয়াজ ব্যবহার হয় না। অন্যদিকে এ ভারতেরই উড়িষ্যা প্রদেশে ফুচকা তৈরির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ পেঁয়াজ। এখানে আলুর পুর তৈরিতে পেঁয়াজ ব্যবহার তো হয়ই, সেসঙ্গে পুরো ডিশ রেডি করার পর সেখানে ডিমের কুচির সঙ্গে কুচি করা পেঁয়াজ আর ধনিয়া-পুদিনার পাতা ছড়িয়ে দিতেও দেখা যায়। তবে দেশজুড়েই দই-ফুচকা বা টক দইসহযোগে পরিবেশিত ফুচকা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে।