Category Archives: বাংলাদেশের ইতিহাস

প্লাজমা ফিজিক্স এবং বাংলাদেশী বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এ এ মামুন

news1369134468956791st_159_tস্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরপরই মামুন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের আরেক প্লাজমা পদার্থবিদ ড. মফিজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে ১৯৯৩’র মার্চ পর্যন্ত প্লাজমা গবেষণা চালিয়ে যান। অধ্যাপক মামুন তাঁর প্লাজমা গবেষণার শুরুতেই যেমন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন উন্নততর দেশে গিয়ে উচ্চতর গবেষণা করার, ঠিক তেমনি তিনি তখন থেকেই অনড় ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন নিজের দেশে ফিরে নিজের দেশে কাজ করার। আর বাংলাদেশে experimental physics এ কাজের সুযোগ কম বিধায় তিনি তখন থেকেই theoretical physics-এ গবেষণার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। তারপর ১৯৯৩ সনের এপ্রিল মাসে অধ্যাপক এম. সলিমুল্লাহর উপদেশক্রমে মামুন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের প্রভাষক পদে যোগদান করেন, এবং একই বৎসর সেপ্টেম্বর মাসে commonwealth scholarship (open competition)  নিয়ে Ph. D. করার জন্য যুক্তরাজ্যের St. Andrews University  চলে যান। তাঁর গবেষণার কর্মস্থল ছিল St. Andrews University  ও Rutherford Laboratory, এবং তাঁর তত্বাবধায়ক ছিলেন দুই বিশ্ব-বিখ্যাত প্লাজমা পদার্থবিদঃ Prof. R. A. Cairns (St. Andrews University) ও Dr. R. Bingham (Rutherford Applied Laboratory, Oxford)।  অধ্যাপক মামুনের Ph. D. Thesis এর মূল উদ্দেশ্য ছিল Viking space craft ও Freja satellite কর্তৃক observed  বিশেষ nonlinear structures এর theoretical ব্যাখ্যা প্রদান। অধ্যাপক মামুন অত্যন্ত সুন্দরভাবে এবং সাফল্যের সাথে (successfully) এর  theoretical ব্যাখ্যা প্রদান করেন। প্রায় দুই বৎসরের মধ্যে তাঁর Ph. D. Thesis এর কাজ সম্পন্ন করেন। তাঁর Ph. D গবেষণাকর্ম কয়েকটি প্রবন্ধাকারে আমেরিকার অতি উচ্চমানের জার্নালে প্রকাশিত হয় ও সেই সঙ্গে এ গবেষণাকর্ম বিশ্বের সমগ্র plasma community কর্তৃক বহুল প্রশংসিত হয়। অধ্যাপক মামুনের এ গবেষণাকর্মের উপর ভিত্তি করে বিশ্বের বিভিন্ন প্লাজমাবিদগণ বিভিন্ন জার্নালে দুই শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এখনও তাঁর এ গবেষণাকর্মকে ভিত্তি করে প্রচুর প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। আরো পড়ুন…. Continue reading প্লাজমা ফিজিক্স এবং বাংলাদেশী বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এ এ মামুন

শিল্পাচার্য জয়নুলের নবান্ন ক্রল পেইন্টিং

image_34664পেইন্টিং বিভিন্ন ধরণের হয়। এগুলোর নামকরণের ক্ষেত্রেও তাই ভিন্নতা লক্ষ  করা যায়। ক্রল পেইন্টিং নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা একজন প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষার্থীর জন্য  বেশ কঠিন। তবুও জয়নুলের নাম শোনর পর থেকে অনেক আগ্রহ জন্মেছিলো এই বিষয়টি কি একটু জানবো। আর জানলে তা আগ্রহীদের জন্য শেয়ার করবো। আভিধানিকভাবে ক্রল পেইন্টিংকে সঙ্গায়িত করার ক্ষেত্রে অনেকগুলো অভিধা লক্ষ করা যায়। এখানে প্রকারতাত্ত্বিক ও গাঠনিক দিককে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। বিশেষ করে কি ধরণের উপাদানের উপর স্ক্রল অংকন করা হবে। আর তা আঁকতে কি ধরণের রঞ্জক উপাদান ব্যবহৃত হবে তা অবস্থা বিশেষে অনেক বেশি গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে।  আমরা অভিধানের পাতায় দৃষ্টি দিয়ে পাই……… Continue reading শিল্পাচার্য জয়নুলের নবান্ন ক্রল পেইন্টিং

একজন প্রত্নতাত্ত্বিক আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়ার গল্প

270512_10151105087801510_24826410_nপ্রথম আলো পত্রিকাটা বাসার ড্রয়িংরুমের ডেস্কে পড়ে থাকলেও খুলে দেখা হয় কম। কিন্তু আজকে দেখেছি। দেখেছি বলা যাবেনা অনেকটা দেখতে হয়েছে। ঘুম থেকে ওঠার পর চাচার হুংকার, পত্রিকাটা দেখ গাধারাম তোর প্রিয় ব্যক্তিকে নিয়ে লিখেছে। পাতা উল্টে দেখি দেশবরেণ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক আবুল কালাম মো. জাকারিয়ার একটি সাক্ষাতকার ছেপেছে ওরা। ব্যাস দাত ব্রাশ করার আগেই অনেকটা দাড়িয়ে দাড়িয়ে পড়লাম পুরো সাক্ষাতকারটি। সত্যি অন্য এক জগতে চলে গেছিলাম। ভাবছিলাম এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে অপেক্ষমান থাকার ঐ সময়টার কথা। তারপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হওয়া। ইতিহাস আর প্রত্নতত্ত্বের সাগরে কিভাবে ডুব দিয়েছিলাম সে কথাও আস্তে আস্তে মনে পড়ছে। কিছুক্ষণের জন্য হয়ে গেছি অন্যমানুষ। আর হবেই না কেনো !! যাঁর কাছে আর্কিওলজির হাতেখড়ি। সেই মহান মানুষটাকে দেখে অনেক ভালো লাগছে। ভাবছিলাম মুনীর চৌধুরী কি ভূল বকেছিলেন। মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়। কিন্তু কৈ প্রিয় জাকারিয়া স্যার তো এতটুকুও বদলে যাননি। Continue reading একজন প্রত্নতাত্ত্বিক আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়ার গল্প

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া


আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার জন্ম ১৯১৮ সালের ১ অক্টোবর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ, গবেষণা এবং প্রত্নসম্পদ অনুসন্ধান, আবিষ্কার ও সংগঠনে তিনি তুলনারহিত। এক শ ছুঁই ছুঁই বয়সেও সদা কর্মব্যস্ত।
মাসউদ আহমাদ: আপনি তো ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন এবং রেজাল্টও ভালো ছিল, প্রত্নতত্ত্বের মতো নীরস বিষয়ে উৎসাহী হলেন কীভাবে?
আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া: আমাদের পরিবারে পুঁথিচর্চার একটা পরিবেশ ছিল। শৈশবে দেখেছি, বাড়িতে পুঁথির বড় সংগ্রহ। আমার বাবা ছিলেন ফারসি ভাষার পণ্ডিত, তিনি পুঁথির পাঠক ও সংগ্রাহক ছিলেন। বই পড়ার প্রতি আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়, পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণেই বলতে পারেন। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয় আমার। এরপর কর্মজীবনের প্রথম থেকেই আমি প্রত্নসম্পদ বিষয়ে জরিপ ও নোট নেওয়া শুরু করি। ১৯৪৬ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে। সেই সময় নৃতত্ত্বের ওপর কাজ করছিলাম আমি। তখন Continue reading আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া

ঘুরে আসতে পারেন ইদ্রাকপুর জলদুর্গ

আনুমানিক ১৬৬০ সালের দিকে বাংলার সুবাদার মীর জুমলা নির্মিত ইদ্রাকপুর দুর্গটি ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ইছামতী নদীর পূর্ব তীরে মুন্সিগঞ্জ জেলা শহরে অবস্থিত। বর্তমানে নদী দুর্গ এলাকা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় জনবসতি গড়ে উঠেছে। নদীপথ শত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপদ রাখতে নির্মিত ইদ্রাকপুর জলদুর্গটি পূর্ব ও পশ্চিমে দু’ভাগে বিভক্ত। পূর্ব অংশ আয়তাকার এবং পশ্চিমের অসম আকৃতির দুটি অংশ মিলিত হয়ে সম্পূর্ণ দুর্গটি নির্মিত হয়েছে। Continue reading ঘুরে আসতে পারেন ইদ্রাকপুর জলদুর্গ

সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী জীবন ও কর্ম

উনিশ শতকের শেষভাগে বাঙালি মুসলমান সমাজে নবজাগরণের যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল তাতে সমকালীন বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ যুক্ত হয়েছিলেন। কোনো সন্দেহ নেই যে সমকালীন আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ নবজাগরণের প্রয়োজন ছিল অপরিহার্য। এটাও অনস্বীকার্য যে, এ প্রচেষ্টায় সুফল ফলেছিল এবং বাঙালি মুসলমানের সার্বিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আমরা ১৮৫৭ সালের ‘সিপাহি বিপ্লব’ বা উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধের কথা স্মরণ করতে পারি।
এটা ঠিক যে, এতে মুসলমানদের ভূমিকা ছিল প্রধান ও অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক, কারণ তারাই ছিলেন শাসক জাতি এবং ক্ষমতা হারানোর জন্য তাদের ভেতরে বিরাজ করছিল প্রচণ্ড ক্ষোভ। এর বহিঃপ্রকাশ এর আগে নানাভাবে ঘটেছে। কিন্তু এ বিদ্রোহের বারুদে যিনি সর্বপ্রথম অগ্নিসংযোগ করেছিলেন, তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ভারতীয় হিন্দু সিপাহি—মঙ্গল পাণ্ডে। Continue reading সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী জীবন ও কর্ম

সেকুলার ধারণার প্রসার ও বাংলার মধ্যযুগ

বাংলাদেশের ইতিহাস প্রকৃত অর্থে বাস্তবতা বিকৃতির ইতিহাস । এটি বললে অনেকেই আতকে উঠতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা বুঝতে পারলে তিনি সহজেই বিষয়টি মেনে নিতে পারবেন। আমাদের দেশের ইতিহাস গবেষকদের মূল সীমাবদ্ধতার ক্ষেত্র বা সমস্যা চিহ্নিত করার দুঃসাহস আমি দেখাবো না শুধু এটুকু বলতে পারি। আমাদের দেশের ইতিহাস চর্চা অনেকটাই থেমে থাকে মধ্যযুগের প্রারম্ভ অর্থাৎ সুলতানী যুগ পর্যন্ত গিয়ে। এই ক্ষেত্রে বাংলার সুলতানী যুগের ইতিহাস অনেকটাই অধরা থেকে যায়। আমরা সুলতানী যুগের ইতিহাস বিশেষত হোসেনশাহী যুগের ইতিহাস অনুসন্ধান প্রসংগে বিষয়টি সহজেই বিশ্লেষণ করতে পারি। ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় আমরা দেখি তুর্কি বিজেতারা বারো শতকের শুরুতে ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেই বিষয়ের সাথে হিসেব মেলাতে গেলে আরো বহুদিন পর প্রায় তের শতকের শুরুতে তাদের রাজনৈতিক সাফল্যের সূচনা ঘটে বাংলায়। বস্তুত বাংলার মধ্যযুগের যাত্রা শুরু হয় এখান থেকেই যেটি আমাদের গবেষণা আর চর্চার অপারগতা হেতু অনেকটাই অন্ধকারে থেকে গেছে।
আমরা দেখি মধ্যযুগের কালপরিসরকে বড় দাগে দুটো পর্বে ভাগ করা যায়। Continue reading সেকুলার ধারণার প্রসার ও বাংলার মধ্যযুগ

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

গত ৩০ মে দৈনিক সমকালের উপসম্পাদকীয়তে আবু সাঈদ খানের ‘পুরাকীর্তি ধ্বংসের প্রক্রিয়া রুখতে হবে’ শিরোনামে লেখাটি পড়লাম। তিনি যতটা না পুরাতাত্তি্বক দৃষ্টিকোণ থেকে, তার থেকে অনেক বেশি স্বাধীন বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে দেশের পুরাতাত্তি্বক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতামূলক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এ অর্থে তিনি অবশ্যই একান্ত কৃতজ্ঞতা ও সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার।
আবু সাঈদ খান বলতে চেয়েছেন, নতুন প্রজন্মকে অতীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আমাদের সভ্যতা ও ঐতিহ্যের আবিষ্কার এবং সংরক্ষণে আজ ব্যাপক উদ্যোগ প্রয়োজন। আমি তার সঙ্গে এ ব্যাপারে পুরোপুরি ঐকমত্য পোষণ করে বিনয়ের সঙ্গে আরও কিছু বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমাদের দেশের প্রচলিত পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনটি দুর্বলতার কারণে বর্তমানে একটি অকার্যকর আইনে পরিণত হয়েছে। এখানে কিছু বিধিনিষেধ প্রকৃত অর্থে আইনের ফাঁকে পুরাকীর্তির ধ্বংসকেই বৈধতা দিয়েছে। অন্যদিকে জনসচেতনতার অভাব, ধর্মীয় গোঁড়ামি ইত্যাদি দেশের প্রত্নতাত্তি্বক ঐতিহ্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। একটি গোষ্ঠী হজরত শাহ সুলতান মাহী সওয়ারের মাজারকেন্দ্রিক লালসালু আখ্যানের বাস্তব রূপায়ণে মহাস্থানগড়ের বিরল প্রত্ননিদর্শন একের পর এক বিনষ্ট করে যাচ্ছে। পাহাড়পুরের মতো বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন এখন গোচারণভূমি। গুপ্ত যুগের নিদর্শন ভরত ভায়নাতেও একই হারে চলছে ধ্বংসযজ্ঞ। ময়নামতির শালবন বিহারের প্রত্নস্থলের ভেতরে এখন সিনেমার শুটিং হয়। একদিন লালবাগ কেল্লায় গিয়ে মহাসমারোহে প্রত্নস্থানের মধ্যেই শুটিং হতে দেখলাম।
আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে, আমরা নিজেরাই আমাদের ঐতিহ্যের রূপকার। আর ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে এটা স্পষ্ট হয়, আমাদের সংস্কৃতি কোনো বহিঃশক্তির কাছে প্রাপ্ত বা ধার করা নয়, নিজেদের সৃষ্টি। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে নিদর্শনগুলো আবিষ্কৃত হওয়ার পর আজ আর কোনো সংশয় নেই যে, যিশুর জন্মেরও বহুদিন আগে বাংলায় আমাদের পূর্বপুরুষরা সভ্যতার আলোকবর্তিকা প্রজ্বলনে সক্ষম হয়েছিলেন। কালের পরিক্রমায় ক্রমাগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে এসেছে আজকের বাংলাদেশিদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি কখনও কখনও বিভিন্ন অপশক্তির করাল গ্রাসে তার ঔজ্জ্বল্য হারালেও একেবারে দীপ্তিহীন হয়ে যায়নি।
আমাদের নিজেদের অতীত সম্পর্কে আমরা যদি জানতে চেষ্টা করি, যদি গণসচেতনতা তৈরি করা সম্ভব হয় তবেই আমাদের হাজার বছরের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করতে পারব। তবে প্রভাবশালী মহল, শিক্ষিত স্বার্থান্বেষী মহলের পাশাপাশি কিছু ব্যক্তির স্বার্থে রাষ্ট্রযন্ত্রই যখন পুরাকীর্তি ধ্বংসের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়, পরিস্থিতি তখন সত্যিই তা এক ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করে। আবু সাঈদ খান তার প্রবন্ধে ময়নামতির পুরাকীর্তি ধ্বংস করে সেই ইট খুলে সরকারি ভবন নির্মাণের কথা উল্লেখ করেছেন, যা হরহামেশাই ঘটছে। সাম্প্রতিক কিছু মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে বগুড়ায় জেলা প্রশাসক কর্তৃক মোগল মসজিদ সম্প্রসারণ, বাগেরহাটে খানজাহান আলীর মাজার ঘেঁষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্ত্রীর কবর তৈরি, স্থানীয় সাংসদ কর্তৃক খানজাহান আলী মাজারসংলগ্ন পুকুরটি আধুনিক টাইলস দিয়ে মোড়ানো, মহাস্থানগড়ের পুরাকীর্তি ধ্বংস করে সেখানে মাজার সম্প্রসারণ, জৈন্তাপুরের মেগালিথিক সমাধির পাথর নিয়ে গিয়ে খাসিয়া পল্লীতে বাড়ির সিঁড়ি তৈরি, ভরত ভায়নায় ইট চুরি, ময়নামতিতে ইট চুরি, প্রত্নস্থানে নাটক-সিনেমার শুটিং করা প্রভৃতি। পুরাকীর্তি সংস্কারের নামে যখন ধ্বংসলীলা চালানো হয় তার পরিণাম আরও ভয়াবহ। পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনকে অনেকে সময় বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রাচীন কীর্তির ওপরেই তাঁবু খাটানো, সংরক্ষিত এলাকায় অফিস, রেস্ট হাউস, বাসভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আবার সংরক্ষণ ও উৎখননে যোগ্য ব্যক্তির নিয়োগ না করা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকায় পুরাকীর্তি ধ্বংসের মাধ্যমে ঐতিহ্যের বিকৃতি ঘটছে। আমাদের দেশের জাতীয় জাদুঘরে কোনো প্রশিক্ষিত প্রত্নতাত্তি্বক নেই। দেশের একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক প্রত্নতত্ত্ব শিক্ষাদান করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে জাদুঘর বিদ্যা মৌলিক অংশ হিসেবে কোর্স শিরোনামে উল্লেখ থাকলেও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে পাস করে বের হওয়া ছাত্রছাত্রীদের দেশের জাদুঘরগুলোতে উপেক্ষিতই রাখা হয়।
আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে এমনি বিভিন্ন জাদুঘরে কী পরিমাণ পুরাকীর্তি রয়েছে, তার হিসাব প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে নেই। বেশিরভাগ অরক্ষিত নিদর্শনের কথা বাদ দিলেও জাদুঘরে রাখা নিদর্শনগুলোকে যথাযথ নিরাপত্তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। আবু সাঈদ খান উলি্লখিত বিষয়ের সঙ্গে আমি যোগ করতে চাই (সমকাল, ২৯ মার্চ ২০১১-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন), জাতীয় জাদুঘর থেকে ১৬টি নিদর্শন খোয়া যাওয়ার পাশাপাশি বিগত ৩০ বছরে হারিয়েছে ১৭২টি নিদর্শন, যার কোনো স্পষ্ট তালিকাও পাওয়া যায়নি। প্রশাসনিকভাবে দুর্বল দু’বছরের জন্য দেশের গণতন্ত্র হত্যাকারী ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন গংয়ের অরাজকতার শাসনকালে প্যারিসের গিমে জাদুঘরে দেশের ১৮৭টি পুরাকীর্তি পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে দেশের সংস্কৃতি সচেতন মানুষ প্রায় সবাই এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। ফলে সেখানে পাঠানো ৪২টি নিদর্শন ফেরত আনা হলেও জাতির কাছে একটা বিষয় আজও ধোঁয়াচ্ছন্নই রয়ে গেছে_ ফেরত আনা নিদর্শনগুলো আসল, না নকল!
আমাদের জাতীয় পরিচয়কে তুলে ধরতে গেলে সভ্যতা ও ঐতিহ্যের আবিষ্কার এবং সংরক্ষণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। প্রশিক্ষিত প্রত্নতাত্তি্বক, ভূতাত্তি্বক, প্রত্ন সংরক্ষণবিদ, প্রত্ন রসায়নবিদ, ভূ-প্রত্নতাত্তি্বক, দূর-অনুধাবন ও জরিপ বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন বিষয়ের অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিদের সহায়তায় আমাদের দেশের বৈচিত্র্যময় এই সাংস্কৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ সম্ভব। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, বেনাপোল থেকে তামাবিল_ এই ছোট্ট ভূখণ্ডের অতীত যে কত সমৃদ্ধ তা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে দেশের সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা একান্তভাবে কাম্য। পাশাপাশি দেশের মানুষকে যদি ঐতিহ্য-সচেতন করে তোলা যায়, তবে সরকারের কাজটি আরও সহজ ও সাবলীল হবে বলেই বিশ্বাস।

ঢাকার চারশ’ বছর উদযাপনে ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে আরও চারশ’ বছর

ইতিহাস গ্রন্থের অনুপস্থিতি, লিখিত সূত্রের অপ্রতুলতা, যথাযথ গবেষণার অভাব আর প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোকে ইতিহাস বিনির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহার না করাতে আমাদের আজকের রাজধানী ঢাকার অতীত গৌরব অনেক ক্ষেত্রে মলিন হয়ে যাচ্ছে। অতি সাম্প্রতিককালে বাংলার তথা আমাদের রাজধানী ঢাকার ইতিহাস নিয়ে যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণভিত্তিক বাস্তবসম্মত গবেষণা করা হচ্ছে তাকে অনেকটা বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শন করে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাকেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দাঁড় করাতে চেষ্টা করা হচ্ছে। এখানে বলা হচ্ছে সতের শতকের গোড়ার দিকে মোগলদের পূর্ববাংলা দখল ও ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের মধ্য দিয়েই গৌরবের নগরী ঢাকার যাত্রা শুরু। ভ্রান্ত হলেও এই প্রচলিত ধারণাকে উপজীব্য ধরে সঠিক ইতিহাস বাদ দিয়ে রাজধানী ঢাকার চারশ’ বছর উদযাপনের এক উত্সবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। Continue reading ঢাকার চারশ’ বছর উদযাপনে ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে আরও চারশ’ বছর