ইতিহাস অনুসঙ্গে তরমুজকাহন


toddler-eating-watermelon-14613278সহজে তৃষ্ণা মেটে কিংবা অসহ্য গরমে শরীর ঠাণ্ডা রাখতে জুড়ি নেই বলে এখন তরমুজের চাহিদাটা বাড়-বাড়ন্ত। শুধু স্বাদ আর বৈরী প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার অনুষঙ্গে একটু সহজসাধ্য রূপ বলেই নয়, পুষ্টিমানের দিক থেকেও বেশ এগিয়ে তরমুজ। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের ধারণা, প্রতিদিন দুই কাপের মতো তরমুজ খেলে শরীরে ভিটামিন ‘এ’ ও ভিটামিন ‘সি’র প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো সম্ভব। একদিকে এতে থাকা পটাশিয়াম শরীরে ফ্লুইড ও মিনারেলসের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে, অন্যদিকে সবুজ খোসাসহ তরমুজ ক্যান্সার রোগীদের জন্য আদর্শ খাবার। পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস, উদরাময় ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ উপকারী তরমুজ।

তরমুজে থাকা কয়েক ধরনের অ্যামাইনো এসিড ক্রমাগত নাইট্রিক অক্সাইড তৈরি করে রক্তের স্বাভাবিক কার্যপ্রণালি বজায় রাখায় তীব্র গরমে এর চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ। প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’র পাশাপাশি বিটা ক্যারোটিনের উপস্থিতি চোখ ভালো রাখতেও বেশ কার্যকর। সম্প্রতি মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বিশ্বজুড়ে যেখানে অনেক বড় সমস্যা, সেখানে প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে তরমুজ। বিশেষ করে প্রচুর পানি ও খুব কম পরিমাণে ক্যালরিযুক্ত খাবার তরমুজ। এটা খেলে পেট ভরে যায় সহজে, কিন্তু সে অনুযায়ী তেমন কোনো ক্যালরি শরীরে যেতে পারে না। ফলে যত ইচ্ছা তরমুজ খাওয়া যেতে পারে, এতে ওজন বাড়ার সম্ভাবনা তেমন থাকে না।

গ্রীষ্মকাল, তরমুজ ও বাংলাদেশ এখন সমার্থক। কেউ কেউ মজা করে বলেন, বাংলাদেশে এখন ঋতু একটাই; মাঝে মধ্যে একটু বৃষ্টিপাত কিংবা শীত— সেটা তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তাই দিনের পর দিন তরমুজের সমাদর বাড়ছে। তবে তরমুজ প্রথম কোথা থেকে এসেছে, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, আফ্রিকায় বুনো পরিবেশে সর্বপ্রথম তরমুজ জন্মাত। সেখানে বিভিন্ন ধরনের তরমুজের দেখা মিলত। একাধারে মিষ্টি, তিতা ও টকজাতীয় তরমুজ সেখানে জন্মাত। উনিশ শতকের দিকে অলফন্সে দ্য ক্যাঁদোল তরমুজকে আফ্রিকার নিজস্ব বলে দাবি করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর জনপ্রিয়তার কারণে তরমুজের জন্মকথা নিয়ে বাক্যবিনিময় কম হয়নি। তবে এর সত্যিকার উত্পত্তিস্থল নিয়ে বিতর্কের শেষটা দেখতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।

মিসরের দাপুটে ফারাও তুতেন খামেনের সময় থেকেই সেখানে তরমুজের বেশ চল ছিল বলে সাহিত্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্রে জানা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে ফারাও তুতেনখামেনের সমাধি থেকে তরমুজের বীজপ্রাপ্তি এ সম্ভাবনাকে আরো জোরালো করে তুলেছে। তবে ভারতবর্ষে তরমুজ আসতে বেশকিছুটা সময় লেগেছিল বলে মনে করা হয়। খুব সম্ভবত দশ শতকের দিকে চীনে তরমুজ আসারও প্রায় ৩০০ বছর আগে সাত শতকে ভারতবর্ষে তরমুজের চাষ শুরু হয়। কর্দোভায় ৯৬১ সালে প্রথমবারের মতো চাষ করা হয়েছিল তরমুজ। তার পর এর মিষ্টি স্বাদ ও পুষ্টিগুণের কারণে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি তেমন। প্রথমদিকে ইউরোপের অনেক শৌখিন মানুষ তাদের বাগানে তরমুজ চাষ করতেন। পরবর্তীকালে বড় পরিসরে এর চাষ শুরু হয়।

ভৌগোলিক আবিষ্কার পর্বে ইউরোপ থেকে অনেক মানুষ পাড়ি জমায় আমেরিকায়। তাদের মধ্যে অনেকে বিশেষ করে আফ্রিকান দাসরা সঙ্গে করে তরমুজের বীজ নিয়ে যায় আমেরিকায়। সেখানে নতুন উদ্যমে তরমুজের চাষ শুরু হলে তা বৈশ্বিক রূপ নেয়। ধীরে ধীরে আমেরিকার প্রায় সব অঙ্গরাজ্যে, এমনকি লাতিন আমেরিকায়ও বেশ জনপ্রিয় ফলে পরিণত হয় এ তরমুজ। পাশাপাশি বেলে দোআঁশ মাটিতে এর চাষ বেশ লাভজনক হওয়ায় বাণিজ্যিক উত্পাদন শুরু হতেও সময় লাগেনি তেমন। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশেও তরমুজের উত্পাদন চোখে পড়ার মতো। এর পুষ্টিগুণ, খাদ্যমান কিংবা বাণিজ্যিক সুবিধা— সব কয়টি দিক চিন্তা করলে বাংলাদেশের কৃষিকেও আশার আলো দেখাতে পারে ফলটি।

মন্তব্য করুন