Category Archives: উপসম্পাদকীয়

এ লাশের মিছিল থামবে কবে?

মো. আদনান আরিফ সালিম অর্ণব
সেদিন দৈনিক আমার দেশসহ দেশের প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় দেখলাম অভিশপ্ত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী কাজী লিয়াকত আলী যুবরাজের মৃত্যু সংবাদ, পর লিয়াকতের পথ অনুসরণ করেছেন আরও কয়েকজন। জানি না আত্মঘাতী এই লাশের মিছিল থামবে কবে! জীবন যখন কারও কাছে বোঝা হয়ে ওঠে, তখন সে ছুটি নিতে চায়। দৌড়ে পালিয়ে বাঁচতে চায়। প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন করে এ দৌড় জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার দৌড়। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে লোকসানের পর লোকসান পরিবার ও সমাজের কাছে লাঞ্ছনা আর হাহাকার সইতে না পেরে রাজধানীর গোপীবাগের আরকে মিশন রোডের ৬৪/৬-জে নম্বরে নিজগৃহে সিলিংফ্যানের সঙ্গে লটকে গেছেন লিয়াকত সাহেব। Continue reading এ লাশের মিছিল থামবে কবে?

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

গত ৩০ মে দৈনিক সমকালের উপসম্পাদকীয়তে আবু সাঈদ খানের ‘পুরাকীর্তি ধ্বংসের প্রক্রিয়া রুখতে হবে’ শিরোনামে লেখাটি পড়লাম। তিনি যতটা না পুরাতাত্তি্বক দৃষ্টিকোণ থেকে, তার থেকে অনেক বেশি স্বাধীন বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে দেশের পুরাতাত্তি্বক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতামূলক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এ অর্থে তিনি অবশ্যই একান্ত কৃতজ্ঞতা ও সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার।
আবু সাঈদ খান বলতে চেয়েছেন, নতুন প্রজন্মকে অতীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আমাদের সভ্যতা ও ঐতিহ্যের আবিষ্কার এবং সংরক্ষণে আজ ব্যাপক উদ্যোগ প্রয়োজন। আমি তার সঙ্গে এ ব্যাপারে পুরোপুরি ঐকমত্য পোষণ করে বিনয়ের সঙ্গে আরও কিছু বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমাদের দেশের প্রচলিত পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনটি দুর্বলতার কারণে বর্তমানে একটি অকার্যকর আইনে পরিণত হয়েছে। এখানে কিছু বিধিনিষেধ প্রকৃত অর্থে আইনের ফাঁকে পুরাকীর্তির ধ্বংসকেই বৈধতা দিয়েছে। অন্যদিকে জনসচেতনতার অভাব, ধর্মীয় গোঁড়ামি ইত্যাদি দেশের প্রত্নতাত্তি্বক ঐতিহ্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। একটি গোষ্ঠী হজরত শাহ সুলতান মাহী সওয়ারের মাজারকেন্দ্রিক লালসালু আখ্যানের বাস্তব রূপায়ণে মহাস্থানগড়ের বিরল প্রত্ননিদর্শন একের পর এক বিনষ্ট করে যাচ্ছে। পাহাড়পুরের মতো বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন এখন গোচারণভূমি। গুপ্ত যুগের নিদর্শন ভরত ভায়নাতেও একই হারে চলছে ধ্বংসযজ্ঞ। ময়নামতির শালবন বিহারের প্রত্নস্থলের ভেতরে এখন সিনেমার শুটিং হয়। একদিন লালবাগ কেল্লায় গিয়ে মহাসমারোহে প্রত্নস্থানের মধ্যেই শুটিং হতে দেখলাম।
আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে, আমরা নিজেরাই আমাদের ঐতিহ্যের রূপকার। আর ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে এটা স্পষ্ট হয়, আমাদের সংস্কৃতি কোনো বহিঃশক্তির কাছে প্রাপ্ত বা ধার করা নয়, নিজেদের সৃষ্টি। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে নিদর্শনগুলো আবিষ্কৃত হওয়ার পর আজ আর কোনো সংশয় নেই যে, যিশুর জন্মেরও বহুদিন আগে বাংলায় আমাদের পূর্বপুরুষরা সভ্যতার আলোকবর্তিকা প্রজ্বলনে সক্ষম হয়েছিলেন। কালের পরিক্রমায় ক্রমাগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে এসেছে আজকের বাংলাদেশিদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি কখনও কখনও বিভিন্ন অপশক্তির করাল গ্রাসে তার ঔজ্জ্বল্য হারালেও একেবারে দীপ্তিহীন হয়ে যায়নি।
আমাদের নিজেদের অতীত সম্পর্কে আমরা যদি জানতে চেষ্টা করি, যদি গণসচেতনতা তৈরি করা সম্ভব হয় তবেই আমাদের হাজার বছরের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করতে পারব। তবে প্রভাবশালী মহল, শিক্ষিত স্বার্থান্বেষী মহলের পাশাপাশি কিছু ব্যক্তির স্বার্থে রাষ্ট্রযন্ত্রই যখন পুরাকীর্তি ধ্বংসের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়, পরিস্থিতি তখন সত্যিই তা এক ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করে। আবু সাঈদ খান তার প্রবন্ধে ময়নামতির পুরাকীর্তি ধ্বংস করে সেই ইট খুলে সরকারি ভবন নির্মাণের কথা উল্লেখ করেছেন, যা হরহামেশাই ঘটছে। সাম্প্রতিক কিছু মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে বগুড়ায় জেলা প্রশাসক কর্তৃক মোগল মসজিদ সম্প্রসারণ, বাগেরহাটে খানজাহান আলীর মাজার ঘেঁষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্ত্রীর কবর তৈরি, স্থানীয় সাংসদ কর্তৃক খানজাহান আলী মাজারসংলগ্ন পুকুরটি আধুনিক টাইলস দিয়ে মোড়ানো, মহাস্থানগড়ের পুরাকীর্তি ধ্বংস করে সেখানে মাজার সম্প্রসারণ, জৈন্তাপুরের মেগালিথিক সমাধির পাথর নিয়ে গিয়ে খাসিয়া পল্লীতে বাড়ির সিঁড়ি তৈরি, ভরত ভায়নায় ইট চুরি, ময়নামতিতে ইট চুরি, প্রত্নস্থানে নাটক-সিনেমার শুটিং করা প্রভৃতি। পুরাকীর্তি সংস্কারের নামে যখন ধ্বংসলীলা চালানো হয় তার পরিণাম আরও ভয়াবহ। পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনকে অনেকে সময় বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রাচীন কীর্তির ওপরেই তাঁবু খাটানো, সংরক্ষিত এলাকায় অফিস, রেস্ট হাউস, বাসভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আবার সংরক্ষণ ও উৎখননে যোগ্য ব্যক্তির নিয়োগ না করা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকায় পুরাকীর্তি ধ্বংসের মাধ্যমে ঐতিহ্যের বিকৃতি ঘটছে। আমাদের দেশের জাতীয় জাদুঘরে কোনো প্রশিক্ষিত প্রত্নতাত্তি্বক নেই। দেশের একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক প্রত্নতত্ত্ব শিক্ষাদান করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে জাদুঘর বিদ্যা মৌলিক অংশ হিসেবে কোর্স শিরোনামে উল্লেখ থাকলেও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে পাস করে বের হওয়া ছাত্রছাত্রীদের দেশের জাদুঘরগুলোতে উপেক্ষিতই রাখা হয়।
আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে এমনি বিভিন্ন জাদুঘরে কী পরিমাণ পুরাকীর্তি রয়েছে, তার হিসাব প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে নেই। বেশিরভাগ অরক্ষিত নিদর্শনের কথা বাদ দিলেও জাদুঘরে রাখা নিদর্শনগুলোকে যথাযথ নিরাপত্তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। আবু সাঈদ খান উলি্লখিত বিষয়ের সঙ্গে আমি যোগ করতে চাই (সমকাল, ২৯ মার্চ ২০১১-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন), জাতীয় জাদুঘর থেকে ১৬টি নিদর্শন খোয়া যাওয়ার পাশাপাশি বিগত ৩০ বছরে হারিয়েছে ১৭২টি নিদর্শন, যার কোনো স্পষ্ট তালিকাও পাওয়া যায়নি। প্রশাসনিকভাবে দুর্বল দু’বছরের জন্য দেশের গণতন্ত্র হত্যাকারী ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন গংয়ের অরাজকতার শাসনকালে প্যারিসের গিমে জাদুঘরে দেশের ১৮৭টি পুরাকীর্তি পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে দেশের সংস্কৃতি সচেতন মানুষ প্রায় সবাই এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। ফলে সেখানে পাঠানো ৪২টি নিদর্শন ফেরত আনা হলেও জাতির কাছে একটা বিষয় আজও ধোঁয়াচ্ছন্নই রয়ে গেছে_ ফেরত আনা নিদর্শনগুলো আসল, না নকল!
আমাদের জাতীয় পরিচয়কে তুলে ধরতে গেলে সভ্যতা ও ঐতিহ্যের আবিষ্কার এবং সংরক্ষণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। প্রশিক্ষিত প্রত্নতাত্তি্বক, ভূতাত্তি্বক, প্রত্ন সংরক্ষণবিদ, প্রত্ন রসায়নবিদ, ভূ-প্রত্নতাত্তি্বক, দূর-অনুধাবন ও জরিপ বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন বিষয়ের অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিদের সহায়তায় আমাদের দেশের বৈচিত্র্যময় এই সাংস্কৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ সম্ভব। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, বেনাপোল থেকে তামাবিল_ এই ছোট্ট ভূখণ্ডের অতীত যে কত সমৃদ্ধ তা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে দেশের সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা একান্তভাবে কাম্য। পাশাপাশি দেশের মানুষকে যদি ঐতিহ্য-সচেতন করে তোলা যায়, তবে সরকারের কাজটি আরও সহজ ও সাবলীল হবে বলেই বিশ্বাস।

আনুষ্ঠানিকতা ও বাস্তবতা

বেরিয়েছিলাম সাতসকালেই ছায়ানটের শিল্পীদের পরিবেশনায় নতুন বছরকে বরণ করার উৎসবকে খুব কাছে থেকে দেখতে। সুবিশাল রমনায় যেন তিল ধারণের অবস্থা নেই। র‌্যাব-পুলিশের পাশাপাশি সিসিটিভি আর ডগ স্কোয়াডের বিশেষ নিরাপত্তার চাদরে মোড়া নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল চোখে পড়ার মতো। বাঁশির মনমাতানো সুরলহরি আর ঢাকের বাজনায় মুখরিত পরিবেশে যখন উৎসব শুরু হয় তখন বাঙালি জাতির একজন ভাবতেই নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয়েছিল। টিএসসি ও এর আশপাশেই বাউল-লালন, জারি-সারি, মুর্শেদি গানের আসর বসেছে এর মধ্যেই। Continue reading আনুষ্ঠানিকতা ও বাস্তবতা

আলোর নিচে অন্ধকার

বিগত হরতালের দিনে তেমন কাজ না থাকায় কয়েক বন্ধু মিলে মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়ে যারপরনাই হতাশ হয়েছি। দেশের প্রচলিত আইনকে অনেকটা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গার্ডেনের অসাধু কর্মচারীরা তাদের অন্যায় উপার্জন করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে হেনস্তাও করছে। যানবাহন না থাকায় অনেকটা হেঁটেই বাসায় ফিরতে হয়। সকালে এক বন্ধুর ফেসবুক নোট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষিকা রুমানা মঞ্জুরের করুণ কাহিনী পড়ে মেজাজটা বিগড়ে ছিল অনেকটাই। এই আধুনিক যুগে বাস করেও পিশাচ স্বামী কীভাবে তার নাক কামড়ে চিবিয়ে দৃষ্টিশক্তি পর্যন্ত কেড়ে নিল, তা ভাবতে অনেকটাই চোখে পানি আসছিল। মনে পড়ছিল মধ্যযুগীয় পিশাচ ক্রুসেডার নাইটদের নৃশংস বর্বরতার কথা।
পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গৃহকর্মী হিসেবে কর্মরত নারীদের দৈহিক ও যৌন নির্যাতন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কীভাবে শিশু আর নারীরা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে এসে শারীরিক ও যৌন হয়রানির শিকার হয়। গত ৩ মে চিত্রনায়িকা নিশির বাড়ি থেকে তার বাসার গৃহকর্মী পিয়ার লাশ উদ্ধার ছাড়াও গৃহকর্মী হাসিনা, গৃহকর্মী নাসরিন, শাম্মী, রেহানাসহ অনেকের নির্যাতনের খবর প্রতিনিয়ত পত্রিকায় আসছে; কিন্তু এ অপকর্মে কেউ শাস্তি পেয়েছে এমন খবর পাওয়া দুষ্কর। এসব ঘটনা ইভ টিজিং, নারী নির্যাতন দমন নীতিমালার আলোর নিচে অন্ধকার হিসেবে দেখা দিয়েছে। নিপীড়নবিরোধী আইন প্রবর্তনে দেশের জনগণ যেমন আশাবাদী হয়েছিল, তেমনি এর প্রায়োগিক দিককেও তেমনি শক্তিশালী করা হোক, যাতে অপকর্ম করা দূরে থাক, কেউ যেন এ ধরনের দুঃস্বপ্নও না দেখে। আইন মানুষের জন্য, মানবতার জন্য আর সবার জন্য সমান, তাই তার চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা। এ উক্তি বইয়ের শক্ত মলাট থেকে বের হয়ে আসুক। বাংলাদেশের মানুষ তার সুফল ভোগ করুক, এ প্রত্যাশা আজ সবার।
দৈনিক সমকাল, শনিবার | ২৫ জুন ২০১১
মোঃ আদনান আরিফ সালিম অর্ণব 
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
aurnabmaas@gmail.com 

তত্ত্বাবধায়ক সরকার, হরতাল ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশ

অতি সম্প্রতি হরতাল দেখে অনেক প্রাচীন দুটি কৌতুক মনে পড়ল। প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষার্থী হিসেবে পুরনো বিষয়াবলী নিয়ে কারবার করা স্বাভাবিক হলেও এগুলোকে আমি কখনোই দেশের সঙ্গে মেলাতে চাইনি। তবু কেন যেন মিলে গেছে। প্রথমটা ছিল এমন—‘এক ভদ্রমহিলার স্বামী পরকীয়ায় পড়ার পর থেকে উনার সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার শুরু করেন। মহিলা প্রথম প্রথম একেবারেই নীরব থাকতেন। কিন্তু হঠাত্ তার আচরণে পরিবর্তন দেখা যায়। উনি স্বামীর বাজে আচরণের সঙ্গে সঙ্গেই কোনো প্রতিবাদ না করে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে যেতেন। বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর অনেকটাই খুশি মনে বেরিয়ে আসতেন। একদিন ভদ্রলোক তার ভুল বুঝতে পেরে পরকীয়া থেকে সরে আসেন। তখন স্ত্রীকে ডেকে পূর্বের ঘটনা জানতে চাইলে ভদ্রমহিলা জানান, ‘আমি প্রতিদিন বাথরুমে ঢুকে তোমার টুথব্রাশ দিয়ে কমোড পরিষ্কার করতাম।’ ভদ্রলোক বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে ড্রয়ার থেকে একটা টুথব্রাশ বের করে স্ত্রীকে দেখিয়ে বললেন, ‘আমিও ভয় পেতাম। তাই কোনোদিনই ওই টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজার চেষ্টা করিনি।’
বাংলা কমিউনিটি ব্লগগুলোর মধ্যে আমার সবথেকে স্বাচ্ছন্দ্যের ‘আমার বর্ণমালা’ ব্লগে গত শুক্রবার রাতে একটি পোস্টে পরিসংখ্যানসহ বহুল আলোচিত-সমালোচিত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ও পাশাপাশি প্রায় সবাই কী পরিমাণ কাঠখড় পুড়িয়েছিলেন তার একটি খতিয়ান তুলে ধরেছিলাম। ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীন গংদের মাত্র দুই বছরের অরাজকতায় ভীত হয়ে এই সরকার পদ্ধতিই বাতিল হবে এমনটা কেউ ভাবতে পারেননি। গোটা জাতি অনেকটা চাতক পাখির মতোই চেয়ে ছিলেন দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে যিনিই ক্ষমতায় আসুন অন্তত এই অরাজকতা সৃষ্টিকারীরা রেহাই পাবে না। দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের গণগ্রেফতার, প্রধান দুই রাজনৈতিক নেত্রীকে রাজনীতি থেকে নির্বাসনের মাধ্যমে দেশের চলমান গণতন্ত্রকে চিরতরে নস্যাত্ করার অপচেষ্টা, দ্রব্যমূল্যকে এভারেস্টের চূড়ায় নিয়ে যাওয়া, জিডিপির মান পাতালে নামানো, দেশের অমূল্য প্রত্ননিদর্শন বিদেশে পাচার—এহেন কাজ নেই তারা করেনি। তবুও জাতিকে অবাক হয়ে দেখতে হয় এই কুচক্রীদের প্রায় সবাই আজ বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে পৃথিবীর হাওয়া-বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অন্যদিকে অনেকটা সুকুমার রায়ের পাগলা দাশু স্টাইলে পায়ের নখ প্রতিদিন ফেটে রক্ত বেরোয় বলে পায়ের আঙুলটাই নরুনের প্যাঁচে ফেলে দেয়া হচ্ছে।
আসলে বিগত নির্বাচনের আগে যখন দেশের গণতন্ত্র হত্যাকারী স্বৈরাচারী লুল সম্রাট এরশাদকে নিয়ে অনেকটা জামাই আদরের সঙ্গে যেভাবে টানাহেঁচড়া চলছিল তখনই জাতি অবাক হয়েছিল। কিন্তু কী আর করা, অনেকটা ওই ভদ্রমহিলার মতো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতি পাঁচ বছর পর পর ভোটাররা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ক্ষমতাসীন দলের পরিবর্তন আনেন। রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের নিজের ব্রাশ সুরক্ষার বিষয়টি বেশ ভালোই জানে। আগের সরকারি দলের প্রতি অতিমাত্রায় বিরক্ত জনগণের ক্ষোভ আর হতাশার বিনিময়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর পরবর্তী দল সময় নষ্ট না করে দ্রুত চেষ্টা করে পাঁচ বছরের এই মুসাফিরখানায় কীভাবে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়া যায় আর কতদ্রুত জনগণকে বিরক্তির শেষ সীমায় নিয়ে যাওয়া যায়। নিত্যদিনের যানজট, বিদ্যুত্ বিভ্রাট, পানির সঙ্কট, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, খুন, ধর্ষণ, যৌন কেলেঙ্কারি, নারী ও শিশু নির্যাতন, সন্ত্রাস, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দ্রব্যমূল্যের বাজারে আগুন, বিঘ্নিত জননিরাপত্তা, জ্বালানি সঙ্কট, আবাসন সঙ্কট, শেয়ারবাজারে ধস আর মুদ্রাস্ফীতিতে টালমাটাল অবস্থায় আমাদের দেশের সরকার ও বিরোধী দল প্রত্যেকেরই একটু সততার সঙ্গে দৃষ্টি দেয়া উচিত ছিল এসব জাতীয় সমস্যার দিকে। সরকারের উচিত ছিল বিরোধী দলের প্রতি দমননীতি পরিহার করে তাদের মতামতকে মূল্য দেয়া, যেখানে বিরোধী দল বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা নয় বরং সরকারের ভুল-ত্রুটিগুলো তুলে ধরিয়ে দিয়ে দেশের কাজে সহায়ক হতে পারতেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এমন স্বপ্ন দেখাও একটি অপরাধ হওয়াতে ক্ষমতালাভের পর থেকে সরকার ও বিরোধী দল দুই মেরুর বাসিন্দা। সবক্ষেত্রে সরকারি দলের আধিপত্য আর বিরোধী দলের লাগাতার বিরোধিতা এ এক পরিচিত দৃশ্য। আর জনগণ বরাবরের মতো যাতনা আর দুর্ভোগে হতাশ হয়ে আবার ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রাখতেই পাঁচ বছর পর প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুতি শুরু করে। তবে এবার নাটকের দৃশ্যপট অনেকটাই পাল্টে যেতে বসেছে। জনগণ যেন পাঁচ বছর পরেও কিছু না বলতে পারে তার সুব্যবস্থা করতেই যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে কবর দেয়া হলো। বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্বাধীনতালাভের এই চার দশকে প্রতিটি ক্ষমতাসীন দলের অধীনে যে কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, পৌর নির্বাচন, মেয়র নির্বাচন কিংবা উপনির্বাচন হয়েছিল তার প্রতিটিই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। জালভোট দেয়া, কেন্দ্র দখল, মারপিট আর সংঘর্ষ ছিল নিত্যদিনের চিত্র। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমস্যার থেকেও অনেক গুরুতর সমস্যা আছে যেগুলো সমাধানে সরকার ও বিরোধী দল প্রত্যেকের সহযোগিতামূলক মনোভাবের ভিত্তিতে এগিয়ে আসতে হবে।
সরকার বা বিরোধী দলের কিছুতেই ভুলে গেলে চলবে না, কেউই এই জনগণ যারা কেবল প্রতিশ্রুতি আর রাজনৈতিক বক্তৃতা বাদে সবক্ষেত্রেই উপেক্ষিত তাদের রায়ের ঊর্ধ্বে নন। সরকার যখন কোনো বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্ত নেয় তখন বিরোধী দল তার দাঁতভাঙা জবাব দিতে মুখস্থ আর বাংলাদেশের বাস্তবতায় অনেকটা ফসিলকৃত বুলি আওড়াতে অভ্যস্ত ‘আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই অপকর্মের সমুচিত জবাব দেব।’ বিপরীতে সরকারি দল বলে থাকে, ‘জনগণ বিরোধী দলের এই অন্যায় আচরণ মেনে নেবে না।’ আসলে দুই ক্ষেত্রেই জনগণের নাম বেশ জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হতে দেখলেও অধিকার আর সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নে এই জনগণই বরাবর উপেক্ষিত। আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা গেছে বৈকি, এই হরতাল কারোই কাম্য ছিল না। অন্যদিকে গ্যাস আর জ্বালানি তেলের মূল্য যেদিন অনেকটাই অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হলো, সেদিন জনগণ বিরোধী দলের কাছ থেকে এর তুমুল প্রতিবাদ আশা করেও হতাশ হয়েছে। যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশে শুধু ট্রামের ভাড়া এক টাকা বাড়ানোয় পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনকে আমরা সরগরম হতে দেখি। সেখানে আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের অন্যায় মূল্যবৃদ্ধিতে যানবাহনের ভাড়া আকস্মিক বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সৃষ্ট জনদুর্ভোগে বিরোধী দল গুনগুন করে যে প্রতিবাদ করেছে তা সরকারের কান অবধি পৌঁছেনি।
আমি শেষ করব নাসির উদ্দীন হোজ্জার একটা মজার গল্প দিয়ে—‘একদিন হোজ্জার ঘরে বেশ জোরে ধুপ করে শব্দ শুনে তার স্ত্রী হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করে প্রশ্ন করলেন, ‘কিসের শব্দ হলো?’ হোজ্জার সাবলীল উত্তর, ‘আমার আলখাল্লাটা পড়ে গিয়েছিল।’ কিন্তু এত জোরে শব্দ হলো কেন!! হোজ্জা কথা না বাড়িয়ে বললেন, আলখাল্লার ভেতরে আমিও যে ছিলাম।’ আসলে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করুন আর বিরোধী দল হরতাল ডাকুন—এখানে আলখাল্লার ভেতরে দেহের মতো দেশের জনগণের দুর্ভোগ জড়িত। যেহেতু প্রতি পাঁচ বছর পর পর এই জনগণের মুখের দিকে অনেকটা বুভুক্ষের মতোই আপনাদের চেয়ে থাকতে হয়, তাদের ভোগান্তির কথা আপনাদের উভয়েরই ভেবে দেখা উচিত। কিছুতেই ভুলে গেলে চলবে না, ফারাক্কার কারণে পদ্মা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেলেও মেঘনা, যমুনা আর কর্ণফুলীর স্রোতের সঙ্গে আজও একাত্তরের সেই বীর শহীদদের রক্তের ধারা বহমান। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, বেনাপোল থেকে তামাবিল—এই ছোট্ট সুন্দর ভূখণ্ডে একটু শান্তির সুবাতাস আর সচ্ছল জীবনের প্রত্যাশায় ওই বীর সেনানীরা তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। তাদের স্বপ্নকে সার্থক করতে এগিয়ে আসা প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক : ব্লগার ও কলামিস্ট
aurnabmaas@gmail.com
দৈনিক আমার দেশ

আনুষ্ঠানিকতা ও বাস্তবতা

বেরিয়েছিলাম সাতসকালেই ছায়ানটের শিল্পীদের পরিবেশনায় নতুন বছরকে বরণ করার উৎসবকে খুব কাছে থেকে দেখতে। সুবিশাল রমনায় যেন তিল ধারণের অবস্থা নেই। র‌্যাব-পুলিশের পাশাপাশি সিসিটিভি আর ডগ স্কোয়াডের বিশেষ নিরাপত্তার চাদরে মোড়া নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল চোখে পড়ার মতো। বাঁশির মনমাতানো সুরলহরি আর ঢাকের বাজনায় মুখরিত পরিবেশে যখন উৎসব শুরু হয় তখন বাঙালি জাতির একজন ভাবতেই নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয়েছিল। টিএসসি ও এর আশপাশেই বাউল-লালন, জারি-সারি, মুর্শেদি গানের আসর বসেছে এর মধ্যেই।
বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও আকাশচুম্বী দামের কারণে অনেকটা অধরা পান্তা-ইলিশ। আবার চিরাচরিত সংস্কৃতিকে কাঁচকলা দেখিয়ে বাবা-মা যে শিশুকে শুরু থেকেই ব্রেড, অমলেট আর স্যান্ডউইচে অভ্যস্ত করেছেন তার কাছে এই পান্তা-ইলিশ আর লঙ্কা লঙ্কাকাণ্ডই মনে হওয়া স্বাভাবিক। তাই দেখলাম বেশিরভাগ শিশুই পান্তার সানকির সামনে বসে আপত্তি জানাচ্ছে। আমরা যখন বাঙালি তবে কেন পুরোটাই বাঙালি হই না? একদিনের জন্য বাঙালি বাঙালি খেলা কেন?
বর্ষবরণ উৎসব সরেজমিন দেখতে একদিন আগে থেকেই ঘুরে বেরিয়েছি বর্তমান আর পুরান ঢাকার বায়ান্ন বাজার আর তিপ্পান্ন গলির নানা স্থান। প্রাচীন বর্ষবরণের রীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত একটি বিষয় হলো হালখাতা, যা কোনো কোনো দোকানি বৈশাখের প্রথম দিন করলেও দ্বিতীয় দিনেও অনেক হিন্দু ব্যবসায়ী হালখাতা উৎসব পালন করবেন বলে জানান। পুরান ঢাকার দোকানিরা পুরো বছরের বাকির খাতা সমাপ্ত করার জন্য পহেলা বৈশাখের দিন অনেকটা ঐতিহ্যগতভাবেই যেখানে এবার কিছুটা ভাটা পড়েছে। একুশ শতকের এই দিনে স্যাটেলাইট আর ইন্টারনেটের ছোঁয়া পাওয়া গ্রামগুলোর বাজার, বন্দর ও গঞ্জে নববর্ষে হালখাতার সেই হিড়িক পড়ে কি-না সন্দেহ থেকেই যায়, সেখানে ঢাকা তো অনেক দূর। আগের বৈশাখী মেলার সঙ্গে ছিল মাটি ও মানুষের নিবিড় সম্পর্ক। আজকের করপোরেট মেলায় তা মেলা ভার।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বসেছে বর্ণিল কনসার্ট। বটমূলের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরপরই শুরু হয়েছে। কিন্তু চড়া সুরের মিউজিক আর ডিজে পার্টির স্টাইলের ড্রামস বিট কেবল খটকাই জাগায়। একটু এগিয়ে যাই কী ঘটছে দেখার জন্য। নববর্ষের প্রথম দিনে উন্মাদ যুবকদের উন্মাদনা আর একটু প্রলম্বিত করে এক কণ্ঠশিল্পী আমাদের সমাজের তুলনায় নিতান্তই বেমানান পোশাকে স্টেজে উঠে বাজেরে বাজেরে ঢোলের রিমিক্স গাইছেন। কিছুক্ষণ পরই শুরু হলো ‘শীলা কি জাওয়ানি’। কীভাবে এই গান বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হতে পারে? বস্তুত পহেলা বৈশাখের আয়োজন আবহমানকাল থেকেই বাঙালির প্রাণের সঙ্গে সংযুক্ত। কিন্তু এর মূল গতিধারার সঙ্গে আমাদের ক্রমে বিচ্ছিন্নতা বৈশাখী অনুষ্ঠানের ঐতিহ্যকে ম্লান করার পাশাপাশি কিছু উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জমি তৈরি করে দিচ্ছে। যা আমরা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে কেন যেন সমর্থন করে আসছি, নামান্তরে পথ বিচ্যুত হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি।
সংস্কৃতি ঐতিহ্যের ব্যাপারেও একটা বদ্ধমূল ধারণা থাকতে হবে। বুঝতে হবে পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতীয় গৌরব। প্রত্যেকের উচিত একে অন্তরে ধারণ করা যেন এটি তার মূল স্রোতধারা খুঁজে পায়। সংস্কৃতির এই দেউলিয়াত্ব থেকে উত্তরণে আমাদের প্রত্যেকের বিশেষত তরুণ সমাজের সচেতনতা একান্ত প্রয়োজন। 
মোঃ আদনান আরিফ সালিম অর্ণব 
aurnabmaas@gmail.com

মহাস্থানগড়ের প্রত্ননিদর্শনের নির্বিচার ধ্বংসসাধন

মহাস্থানগড়ের প্রত্ননিদর্শনের নির্বিচার ধ্বংসসাধন

উপসম্পাদকীয়,
আমার দেশ, ১০ মার্চ ২০১১

ঐতিহ্যের মহাস্থানগড়

হাইকোর্টের জারিকৃত বিধি অমান্য করে কতিপয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, কুচক্রী সরকারি আমলা ও প্রভাবশালী মহলের নির্লজ্জ ভূমিকায় ইতিহাস, ঐতিহ্য আর পর্যটনে সমান গুরুত্ববহ প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার নিদর্শন মহাস্থানগড় আজ ধ্বংসের পথে। এই নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ ইতিহাস-ঐতিহ্য সচেতন মানুষ বৈ কি, সমগ্র জাতিকে আজ করেছে বিস্মিত হতবাক। কিংবদন্তিকে আশ্রয় করা বলখি মাহি সওয়ারের মাজারকে কেন্দ্র করে যে নব্য লালসালু আখ্যান রচিত হয়েছে, তার মঞ্চায়নই আমাদের প্রাচীন সভ্যতার এই বিরল নিদর্শনের ধ্বংসযজ্ঞে বৈধতা দিচ্ছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গ আর সরকারি কতিপয় আমলার ভূমিকা। আমরা প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে ফ্রান্স-বাংলাদেশ যৌথ খনন প্রতিবেদনের রেডিও কার্বন তারিখকে সূত্র ধরে এর সময়কাল জানতে পারি খ্রিস্টপূর্ব তিন থেকে চার শতক। অর্থাত্ বহুল পরিচিত ভ্রমণ কেন্দ্র ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের প্রাণকেন্দ্র বগুড়ার মহাস্থানগড়কে আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা বলাটা অযৌক্তিক হবে না। চারদিকে প্রাচীরবেষ্টিত এই সুপ্রাচীন আদি ঐতিহাসিক সময়কালের বিখ্যাত দুর্গনগরীটি বিকশিত হয়েছিল বগুড়া শহর থেকে উত্তরে প্রায় তেরো কিলোমিটার দূরে নদীমাতৃক বাংলা ভূখণ্ডের অন্যান্য সভ্যতার মতো করতোয়া নদীর কূল ধরে। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হিসেবে এর রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষী দেয় মৌর্য সম্রাট মহামতি অশোকের শিলালিপি। প্রাচীন ব্রাহ্মী হরফে উত্কীর্ণ এই লিপিতে পুডনগল বা পুণ্ড্রনগর তথা এই মহাস্থানগড়ের তত্কালীন শাসক দুমদিনকে দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণকে সাহায্য করার কথা বলা হয়, যা মৌর্য শাসনামলে মহাস্থানগড়ের গৌরবকে তুলে ধরতে যথেষ্ট হয়েছে। ইতিহাসের পাতা থেকে এই উক্তিগুলো তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করলাম তাদের জন্য যারা একেবারে নবীন অর্থাত্ বিজ্ঞানের বা বাণিজ্যের ছাত্রছাত্রী বা সাধারণ মানুষ। তারা কিছুটা হলেও এই গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটির মূল অবস্থা বোঝার পথ পাবেন। মৌর্য আমল থেকে শুরু করে এর ধারাবাহিক গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে ধারণ করেছিল গুপ্ত ও পাল রাজাদের আমলের প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে, যা আজ নেই কিন্তু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই সময়ের নির্বাক জড় পদার্থগুলো ইটের দেয়াল, দুর্গের নিদর্শন আর মূর্তি হয়ে। বিস্তৃত পরিসরে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ, অনুসন্ধান ও কয়েক দফা উত্খননের ফলে মহাস্থানগড়ে উন্মোচিত প্রত্ননিদর্শনগুলোর মধ্যে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে পারি ভাসু বিহার, ভীমের জাঙ্গাল, বৈরাগীর ভিটা, গোবিন্দ ভিটা, কালিদহ সাগর, জিয়ত কুণ্ড, গোকুল মেধ বা কিংবদন্তির বেহুলা-লখীন্দরের বাসর ঘর, খোদার পাথর ভিটা, মানখালীর কুণ্ড, বন্দুকধারা, হাতিবান্ধা, ধোপাপক্রা বা ধোপার পুকুর, হাতিডোবা পুকুর, মনিরঘোন, শিলাদেবীর ঘাট, মথুরা চিঙ্গাসপুর, কাঞ্জিরহাট, ছেলীরধাপ, গোদার ধাপ, কানাইধাপ প্রভৃতি। এটির প্রাচীর ও পরিখাবেষ্টিত দুর্গ নগরীর চারদিকে অনেক বিক্ষিপ্ত মানববসতির চিহ্নও ছিল। যেগুলো ইতিহাস-ঐতিহ্যের গৌরবকে তুলে ধরার পাশাপাশি মহাস্থানগড়কে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। এছাড়া মুসলমান, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হিসেবেও মহাস্থানের পরিচিতি সর্বজনবিদিত। কিংবদন্তি অনুযায়ী প্রখ্যাত কামেল হজরত শাহ সুলতান বলখী মাহী আছোয়ার বা মাহীসওয়ার (রহ.) এই স্থানের রাজা পরশুরামের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হন; যার ফলে পরবর্তীকালে মহাস্থানগড় পরিচিতি পায় মুসলমানদের বসতি এলাকা হিসেবে আর তা একে হাজার হাজার মুসলিম জনতার কাছে পবিত্র স্থানের মর্যাদা দিতে যথেষ্ট হয়। এরপর থেকেই মহাস্থানে সমাগম হতে থাকে হাজার হাজার মানুষের, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন অনেকটা তীর্থযাত্রীদের মতো। আর বলখী মাহীসওয়ারের মাজারকেন্দ্রিক জনপ্রিয়তা অনেকটা জমি তৈরি করে দেয় এই নব্য লালসালু নাটকের বৈধ মঞ্চায়নের। নাটকটির কুশীলবরা ক্ষমতার যাচ্ছেতাই অপব্যবহার ও প্রচলিত আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশের ঐতিহ্য বিনষ্ট করে হুমকির সামনে ঠেলে দিচ্ছে আমাদের সোনালি অতীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নকে। মহাস্থানগড়ের সমৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেশ-বিদেশের পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়েছে। এটি ইতিহাস-ঐহিহ্যের লীলাভূমি হওয়ার পাশাপাশি আত্মপ্রকাশ করেছে অনেকটা বিনোদন পার্কের মতো দর্শনীয় স্থান হিসেবে। এর পাশাপাশি মহাস্থানগড় মাজার এলাকাতে প্রতি বছর বৈশাখ মাসে বিশাল মেলা বসে, যা দর্শক আকর্ষণের অন্যতম কারণ। হারিয়ে যাওয়া অতীত ইতিহাসের সেই সোনালি যুগের স্থাপত্যকে দু’চোখ ভরে দেখতে, একটু কাছে থেকে একান্ত নিজের করে অনুভব করতে, নিজের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করতে, চাই কি একটু নির্মল বিনোদন নিতে প্রতিদিন হাজারো শিশু, নারী ও পুরুষের সমাগম ঘটে মহাস্থানগড়ে। প্রধানত ছুটির দিনগুলোতে ও হিন্দু-মুসলিম ধর্মানুষ্ঠানের সময় এই স্থানে আপামর জনতার উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। মহাস্থানগড়ের অতীত ঐতিহ্য ও পর্যটন ক্ষেত্রে এর গুরুত্বকে উপলব্ধি করে ১৯৬৭ সালের দিকে এখানে প্রত্নস্থানভিত্তিক জাদুঘর নির্মাণ করা হয়, যেটি বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আছে। জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর এখানে প্রদর্শিত হতে থাকে উত্খনন ও উপরিপৃষ্ঠ সংগ্রহে প্রাপ্ত অতীত ঐতিহ্যের সাক্ষী নানা বস্তুগত নিদর্শন। পাশাপাশি নিকটস্থ নানা স্থান থেকে সংগ্রহকৃত প্রত্ননিদর্শনও এখানে স্থান পায়। যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন পাথর নির্মিত ও ধাতব মূর্তি, ধাতব পাত্র, মৃত্ পাত্র, পোড়ামাটির নিদর্শন, মুদ্রা, শিলালিপি, অস্ত্রশস্ত্রসহ দৈনন্দিন ব্যবহার্য নানা সামগ্রী। আর পর্যটকদের কথা বিবেচনা করে এখানে নির্মিত হয়েছে অত্যাধুনিক ইমারত। মহাস্থান জাদুঘরের দায়িত্বে থাকা কাস্টডিয়ানের অনুমতি সাপেক্ষে এখানে পর্যটকরা থাকার সুবিধা লাভ করেন। মহাস্থান জাদুঘরের খতিয়ান অনুযায়ী প্রতিষ্ঠালাভের পর থেকেই এটির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার তথ্য মেলে। যার সাক্ষী মহাস্থান সংলগ্ন জাদুঘরের রেকর্ড বইতে সংরক্ষিত ক্রমবর্ধমান দর্শকের সংখ্যা। ১৯৯৫-৯৬ সালের দিক থেকে এখানে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৯৮-৯৯ সালে এখানে দর্শনার্থী ছিল দুই লাখের মতো। আর ২০০০-০১ সালের দিকে তা প্রায় সাড়ে তিন লাখে গিয়ে দাঁড়ায়। ২০০২-০৪ সালের দিকে এটি বেড়ে হয় প্রায় আট লাখের মতো, আর তা ২০০৪-০৬ সালে এসে দশ লাখ ছাড়িয়ে যায় এবং আজ অবধি বেড়েই চলেছে। বাকি সবকিছু বাদ দিলে কেবল টিকিট বিক্রি থেকেই বার্ষিক আয় পাঁচ কোটি টাকার ওপর।। পুরাবস্তুতেই আমরা প্রত্নতাত্ত্বিকেরা খুঁজে ফিরি অতীতের প্রতিবিম্ব। এই মূক-বধির ইটগুলো, এই পাথরের নির্বাক মূর্তিগুলোই আমাদের সোনালি অতীতের একমাত্র তথ্যপ্রমাণ যা আজ ধ্বংসের পথে।
মহাস্থানগড়ের অতি সাম্প্রতিক ধ্বংসযজ্ঞটি শুরু করা হয় গত বছরের ২৭ নভেম্বর, যার বিরুদ্ধে দেশের ঐতিহ্য সচেতন ব্যক্তিবর্গ তত্ক্ষণাত্ তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করলেও তা সাড়ম্বরে চলতে থাকে। মহাস্থানের প্রত্নস্থানভিত্তিক জাদুঘরের কাস্টডিয়ান নাহিদ সুলতানা স্থানীয় সুধীজন ও সাংবাদিকদের সহায়তায় এর বিরুদ্ধে তীব্র অবস্থান নেন এবং প্রতিরোধের চেষ্টা করেও প্রভাবশালী মহলের কারণে বার বার ব্যর্থ হন। একটি কথা প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, অতীত নিদর্শনে ভরপুর মহাস্থানগড়ের যে কোনো স্থানে একটু খনন করলেই সেখানে মূল্যবান প্রত্নসামগ্রীর দেখা মেলে। আর তাতেই উত্সাহিত হয়ে এখানকার অতীত নিদর্শনের ধ্বংসযজ্ঞ চালানো কোনো নতুন ঘটনা নয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের মাঝামাঝি স্থানীয় শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের কর্মসৃজন প্রকল্পের আওতায় একটি রাস্তা নির্মাণে বড় টেঙরা ধাপের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করা হয়। ২০১০ সালের ৭ ডিসেম্বর এই মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদে হিউম্যান রাইটস ফর পিস ইন বাংলাদেশ এই ধ্বংসযজ্ঞের দ্বারা সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন দাখিল করে। বাংলাদেশের সংবিধানে জাতীয় ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণে এর অন্তর্ভুক্ত অংশে পুরাকীর্তির ক্ষতিসাধন করে যে কোনো স্থাপত্য নির্মাণ আইনত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এই নির্মাণের নামে ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধে দ্রুত রুল জারি করেন। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী স্থানীয় নেতা, বিভাগীয় কমিশনার আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মদতে হাইকোর্টের রুল ভঙ্গ করে এই এলাকাতে অবৈধভাবে খনন পরিচালনা করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি মহাস্থানগড় সংযুক্ত একটি ঢিবি নিতাই ধোপানীর পাটের মাটি সরিয়ে সেখান দিয়ে রাস্তা নির্মাণের উদ্দেশ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক অপর একটি কর্মসৃজন প্রকল্প হাতে নেয়া হলে তৃণমূল পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ স্থানীয় সাংবাদিকরা দ্রুত এর প্রতিবাদ জানান। হাইকোর্টের ওই একই বেঞ্চ দশ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও তাদের অধিকাংশই সরকারি আমলা, পাশাপাশি প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাদের ধারণাও সুস্পষ্ট নয়। পাশাপাশি এলাকার প্রভাবশালী মহলের প্রত্যক্ষ মদতে হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নজর এড়াতে এখন রাতের আঁধারে খনন কাজ চলছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে শ্রমিক লাগিয়ে মাজার উন্নয়ন কমিটির পক্ষে মহাস্থানগড়ের মূল মাজার এলাকায় উঁচু স্থানের ওপর প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ পুণ্ড্র গেট বা ‘পুণ্ড্র নগরীর প্রবেশদ্বার’ এলাকায় ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ির মাধ্যমে এই স্থানের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করা হয়। খননের সময় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমৃদ্ধ মহাস্থানগড়ের মাটির নিচ থেকে প্রচুর প্রত্ননিদর্শন বের হয়ে এলে সেগুলো গুম করতে নিকটবর্তী একটি স্থানে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়, যেগুলো গত বুধবার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তারা মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করেন। প্রত্যক্ষদর্শী, এলাকবাসী ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাষ্যমতে, রাত ১২টার পর লোকচক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে শ্রমিক লাগিয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। তারা সবাই গভীর রাতে শ্রমিকদের কাজ করার প্রমাণ হিসেবে সকালে পুণ্ড্র গেট সংলগ্ন স্থানে বালি বিছানো দেখতে পান। পরে আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে জানা গেছে, সেখানে রাতে শ্রমিকরা খনন কাজ করেছে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই স্থানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টডিয়ান নাহিদ সুলতানার অভিমত—‘অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, যারা খনন কাজ করেছে তারা প্রথমে চিন্তাই করেনি সেখানে প্রাচীন নিদর্শনাবলি থাকতে পারে। পরে নিদর্শনগুলো বের হয়ে এলে সেগুলো গুম করতে রাতেই সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়। প্রচেষ্টা হিসেবে আগেই খুঁড়ে রাখা একটি গর্তের মধ্যে নিদর্শনগুলো ফেলে মাটিচাপা দেয় তারা। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অভিজ্ঞ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গত বুধবার সকালে আলগা নতুন মাটি দেখে সন্দেহ হলে মাটি সরাতে শুরু করেন। তারা মাটি সরিয়ে ব্ল্যাক স্টোন, প্রাচীন স্থাপত্যের অংশ হিসেবে ইট, অমূল্য কিছু টেরাকোটা নিদর্শন ও মূর্তির ভগ্নাংশ উদ্ধার করতে সক্ষম হন। এ ঘটনার পর থেকে অপকর্মের নায়কসহ প্রায় সব কুশীলব এবং মহাস্থান মাজার উন্নয়ন কমিটির নেতারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। পাশাপাশি এই ঘটনাটি প্রকাশ না করার জন্য তাদের মাঠকর্মীদেরও বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, বারবার খননের জন্য লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ঠিক করা স্থানটির নিচেই লুকিয়ে থাকতে পারে ইতিহাস-ঐতিহ্যের পুণ্ড্র নগরীর গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভবন। কারণ মূল মাজার ও মসজিদ সংলগ্ন টিলার মতো উঁচু জমিটি মূল পুণ্ড্র নগরীর অংশ, যেখানে বসবাস করতেন রাজা ও তার অমাত্যবর্গ। ফলে পুণ্ড্র রাজার রাজপ্রাসাদ ও প্রশাসনিক ভবন এখানেই থাকার কথা। জমিটি মাজার কমিটির বলে দাবি করা হলেও সংবিধান অনুযায়ী এটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় পড়ে। এখানে ইচ্ছে করলেই কেউ খোঁড়াখুঁড়ি কিংবা অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারবে না। কিন্তু তাদের লোকজনকে ভয়ভীতি দেখিয়ে রাতের আঁধারে খোঁড়াখুঁড়িতে প্রাপ্ত অমূল্য প্রত্নসামগ্রী অবলীলায় হাপিস করা হচ্ছে। নাহিদ সুলতানা জানান, তিনি ঘটনাটি দেখার পর এ ব্যাপারে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেও তেমন কোনো ফল পাননি। গত বুধবার সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, পুণ্ড্র নগরীর নিদর্শনগুলোর একেবারে কেন্দ্রস্থলে হজরত শাহ সুলতান বলখি মাহী সওয়ারের (র-.) মাজারের পশ্চিম পাশে প্রায় ২০০ বর্গফুট এলাকায় খনন কাজ করা হয়। ফরিদপুর জেলার অধিবাসী সোলেমান আলী রাতে খনন কাজ প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি জানান, রাতে যখন খনন করা হয় তখন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি বেশকিছু পাথর ও ভাঙা ইটের অংশ সেখান থেকে সরিয়ে ফেলতেও দেখেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্থানীয় স্কুল শিক্ষক বলেন, আমরা সব দেখি-শুনি, তারপরও মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া আর কোনো গতি থাকে না কারণ প্রাণের মায়া প্রত্যেকেরই আছে। গর্ত খোঁড়ার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের কাছে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা আড়াই হাজার বছর আগের নিদর্শনের কোনো দাম নেই, পাশাপাশি অতিরিক্ত মজুরির লোভে তারা মহামূল্যবান এই অতীত নিদর্শনগুলো অবলীলায় ধ্বংস করার কাজে মত্ত হতে পারছে। মহাস্থান মাজার উন্নয়ন কমিটির সদস্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ এই কাজের দায়িত্ব নিজেদের ঘাড়ে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার পর সেখানে খোঁড়াখুঁড়ির কোনো অর্থ হয় না। তবে বাইরের কেউ এই কাজ করতে পারে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি মুখ খোলেননি। মহাস্থান মাজার কমিটির সভাপতি বগুড়ার জেলা প্রশাসক ইফতেখারুল ইসলামের কাছে স্থানীয় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি জানান, তিনি বিষয়টি জানেন না। তিনি এটি শনাক্ত করতে শিবগঞ্জ থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান।
আমরা দেখেছি, ভারতের মৌলবাদী গোষ্ঠী বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির নির্মাণ করেছে। আফগানিস্তানের তালেবান আমলে ধ্বংস করা হয়েছে বামিয়ানের বিশাল বৌদ্ধ প্রতিকৃতিগুলো। আর ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের পর বাগদাদ জাদুঘরে চালানো হয়েছে লুণ্ঠন। কিন্তু আজ বাগদাদ-বামিয়ান নয়, ভারতের বাবরি মসজিদ নয়—আমাদের বাংলাদেশে এটা কী হচ্ছে? এই প্রশ্ন আমার আপনার সবার। আমাদের প্রশ্ন জাতির বিবেকের কাছে। খোদ সরকারি নির্দেশকেই অমান্য করে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ধৃষ্টতা যারা দেখাচ্ছে, সরকারের উচিত একটিবারের জন্য হলেও প্রমাণ করা—কোনো অন্যায়কারীই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আসলে ষণ্ডাতন্ত্র ঐতিহ্যের কথা দূরে থাক, নিজের মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই অপারগ, আপাতত সেখানে বলার কিছু থাকে না। তারপরও এসব প্রভাবশালী মহলের মদতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পাশাপাশি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের ছা-পোষা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানাভাবে হুমকি-ধমকি আর হয়রানি করার যে প্রক্রিয়া চলছে; আমরা চাই প্রশাসন এর বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। যার মাধ্যমে দেশের ঐতিহ্যের পাশাপাশি কয়েকজন কর্তব্যনিষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে। আর এই একুশ শতকে বাস করেও সৈয়দ ওয়ালীউল্লার লালসালু উপন্যাসের বাস্তব রূপায়ণের এই নীল নকশা রুখে দেয়া সম্ভব হবে। এই অপকর্ম রোধে বাংলাদেশ সরকারের সহায়তা মিললে মহাস্থানগড় হয়তো একটি বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি লাভ করবে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলাকালীন ভারতের নানা স্থানে প্রদর্শিত বিলবোর্ডগুলোর অধিকাংশই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ও প্রত্নকীর্তি সম্পর্কিত। আর এটাকে উদাহরণ হিসেবে নিলে বাংলাদেশের জন্য অন্যতম হবে এই মহাস্থানগড়। তাই দেশে পর্যটন শিল্পের প্রসার, সুস্থধারার নির্মল বিনোদনলাভের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি সরকারের রাজস্বে সমৃদ্ধি আর পর্যটনকেন্দ্রিক বাণিজ্যের বিকাশে অনেকেই হয়তো মুক্তিলাভের সুযোগ পাবে দারিদ্র্য আর বেকারত্বের অভিশাপ থেকে। আর আমরাও এগিয়ে যেতে পারব এক সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের দিকে।
জয়ন্ত সিংহ রায়
সহকারী অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাবি,
মোঃ আদনান আরিফ সালিম অর্ণব
শিক্ষার্থী, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাবি।

পুরাতাত্ত্বিক লুই বিনফোর্ডের মহাপ্রয়াণে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি

পুরাতাত্ত্বিক লুই বিনফোর্ডের মহাপ্রয়াণে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি

মো. আদনান আরিফ সালিম অর্ণব

প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিজ্ঞাননির্ভর ধারণা প্রতিষ্ঠার প্রবাদপুরুষ প্রক্রিয়াবাদী প্রত্নতত্ত্বের জনক, প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক লুই রবার্টস বিনফোর্ড বিশ্বব্যাপী তাঁর অগণিত শিক্ষার্থী এবং গবেষককে শোক সাগরে ভাসিয়ে গত ১১ এপ্রিল ২০১১ জন্মস্থান যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরী অঙ্গরাজ্যের কির্কসভিলে চিরবিদায় লাভ করেছেন। ১৯৩১ সালের ২১ নভেম্বর জন্ম নেয়া বিনফোর্ডের মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। দীর্ঘ ৫০ বছরের কর্মজীবনে তিনি দেড় শতাধিক গ্রন্থ এবং গবেষণা প্রবন্ধ রচনা ও সম্পাদনা করে গেছেন। আলাস্কার নুমিয়ান্ট এস্কিমোদের ওপর দীর্ঘ গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা তাঁকে প্রত্নতত্ত্বের গবেষণায় নতুন একটি ধারার উন্মোচনে পথ দেখায়। তাঁর সঙ্গে ভারতের পুনার ডেকান কলেজের গবেষক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটা ভালো যোগ ছিল। ডেকান কলেজের প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক কে. পাদায়ার উদ্ধৃতি দিয়ে ভারতের একটি ইংরেজি দৈনিক বলেছে,
মৃত্যুকালে তিনি হৃদরোগে ভুগছিলেন। আধুনিক ইউরোপে সামাজিক বিজ্ঞান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানের বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই তাত্ত্বিক ঘরানার নানা মারপ্যাচে উপনিবেশবাদের ভিত্তি মজবুত করতে সচেষ্ট ছিল। সমাজ গবেষণার অন্যতম বিষয় হিসেবে ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বাইরে ছিল না বরঞ্চ এটি উপনিবেশবাদী শক্তির ভিত্তিমূলকেই ইস্পাতদৃঢ় করতে কাজ করেছে, যা থেকে তিনিই প্রথম বেরিয়ে আসার পথ দেখান। প্রত্নতত্ত্বের প্রাথমিক দিকে প্রচলিত নীতির কঠোর সমালোচনার মাধ্যমে আবির্ভাব ঘটেছিল ক্ষণজন্মা গবেষক লুই বিনফোর্ডের। তিনি অতীত মানুষের জীবনযাত্রার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে পূর্বতন হঠকারী বস্তুগত উপাদানের উপস্থাপননির্ভর সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে সংস্কৃতিকে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখার মাধ্যমে অতীত গবেষণার প্রস্তাবনা আনেন। সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক ধারার অতীত চর্চায় প্রকৃত অর্থে ঔপনিবেশিক শক্তি কোনো অঞ্চলে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করার পর উপনিবেশকে বৈধতা দেয়ার জন্য ওই স্থানের সঙ্গে তাদের অতীত সম্পর্ক প্রমাণের ঐতিহাসিক সত্তাকে আগে থেকেই নির্মাণ করে নিত। আর তাকে বাস্তবসম্মত করতে ব্যবহার করত প্রত্নতত্ত্ব বা নৃবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোকে। এখানে তারা ইউরোপীয় দর্শনের দুটি ধারা বিশেষত দৃষ্টবাদ ও প্রত্যক্ষণবাদকে গুরুত্ব দিয়ে অতীত মানুষের সংস্কৃতি সম্পর্কিত বস্তুগত উপাদানকে সরাসরি সাংস্কৃতিক নর্মের উপস্থাপন বলে প্রমাণে সচেষ্ট হলে তখনকার প্রত্নতত্ত্ব চর্চার সঙ্গে পুকুর খোঁড়া বা কবর খুঁড়ে মাটি তোলার বিশেষ পার্থক্য ছিল না। তখনই লুই বিনফোর্ড তার সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার ধারণা নিয়ে অনেকটা ধূমকেতুর মতোই আবির্ভূত হন। তিনি পূর্বের এসব বিষয়কে নাকচ করে দিয়ে সংস্কৃতিকে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখার কথা বলেন যেখানে পরিবেশের ভূমিকাও অনেক গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। ফলে মাটি খোঁড়া আর প্রয়োজনীয় বস্তুর আলোকে ইচ্ছামতো তৈরি করা ইতিহাস রচনার মাধ্যমে কোনো জনগোষ্ঠীর অতীতকে খেলো করার পথে অনেকটা কাঁটা বিছিয়ে দিয়ে ইউরোপীয় প্রত্নতাত্ত্বিকদের চক্ষুশূল হন বিনফোর্ড। তাঁরা বিনফোর্ডের প্রবর্তিত ঘরানাকে অনেকটা হাস্যকর প্রতিপন্ন করে নব্যধারার প্রত্নচর্চা বলে নামকরণ করে। কিন্তু বহুলাংশে বস্তুনিষ্ঠতা আর বাস্তবতার যোগ থাকাতে বিনফোর্ডের প্রবর্তিত অতীত গবেষণা পদ্ধতি ধীরে উপনিবেশিত অঞ্চলগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে আর আজও তা আমেরিকার মতো দেশে অন্যতম দাপুটে একটি রীতি হিসেবে গবেষক মহলে সমাদৃত। নতুন প্রজন্মের ইতিহাস ঐতিহ্য ও নৃবিজ্ঞানের গবেষকদের কাছে বিনফোর্ড একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।
Archaeology Of Humankind 
মোঃ আদনান আরিফ সালিম অর্ণব 
শিক্ষাথী, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাবি
aurnabmaas@gmail.com

কালজয়ী পুরাতাত্ত্বিক লুই বিনফোর্ড


কালজয়ী পুরাতাত্ত্বিক লুই বিনফোর্ড
আদনান আরিফ সালিম
লুই বিনফোর্ড
অমোঘ নিয়তির কাছে নতি স্বীকার করে প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী ও প্রত্নতাত্তি্বক গবেষক লুই রবার্টস বিনফোর্ড নিজ জন্মস্থান যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের কির্কসভিলে ১১ এপ্রিল ২০১১ তার কর্মময় জীবনের ইতি টেনেছেন। ১৯৬০ সালের দিকে সামাজিক বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব ও নৃবিজ্ঞানের গবেষণাতে সরাসরি বিজ্ঞানের বিধির ব্যবহার করে এক বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন লুই বিনফোর্ড। দীর্ঘ ৫০ বছরের বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনে তার রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ আর গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। আলাস্কার নুমিয়ান্ট এস্কিমোদের ওপর দীর্ঘ গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতায় তিনি প্রত্নতাত্তি্বক তত্ত্ব ও অনুশীলনে নতুন একটি ধারা উন্মোচনের পথ খুঁজে পান, যা তাকে গবেষণার পরিসরে কিংবদন্তির আসন করে দেয়। তার সঙ্গে ভারতের পুনার ডেকান কলেজের গবেষক ও প্রত্নতাত্তি্বকদের একটা ভালো যোগ ছিল। সমাজ গবেষণার অন্যতম বিষয় হিসেবে ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বাইরে ছিল না

বরং এটি উপনিবেশবাদী শক্তির ভিত্তিমূলকেই ইস্পাত দৃঢ় করতে কাজ করেছে, যা থেকে তিনিই প্রথম বেরিয়ে আসার পথ দেখান। প্রত্নতত্ত্বের প্রাথমিক দিকে প্রচলিত নীতির কঠোর সমালোচনার মাধ্যমে আবির্ভাব ঘটেছিল ক্ষণজন্মা গবেষক লুই বিনফোর্ডের। তিনি অতীত মানুষের জীবনযাত্রার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বস্তুগত উপাদানের উপস্থাপননির্ভর সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে সংস্কৃতিকে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখার মাধ্যমে অতীত গবেষণার প্রস্তাবনা আনেন। সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক ধারায় অতীত চর্চার ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে ঔপনিবেশিক শক্তি কোনো অঞ্চলে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করার পর উপনিবেশকে বৈধতার জন্য ওই স্থানের সঙ্গে তাদের অতীত সম্পর্ক প্রমাণের ঐতিহাসিক সত্তাকে আগে থেকেই নির্মাণ করে নিতেন। আর তাকে বাস্তবসম্মত করতে ব্যবহার করতেন প্রত্নতত্ত্ব বা নৃবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলো। এখানে তারা ইউরোপীয় দর্শনের দুটি ধারা বিশেষত দৃষ্টিবাদ ও প্রত্যক্ষণবাদকে গুরুত্ব দিয়ে ইতিহাস নির্মাণে অন্ধের যষ্ঠির মতো অতীত মানুষের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সংশ্লিষ্ট বস্তুগত উপাদানকে এক এবং একমাত্র পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। তাদের কর্মকাণ্ডে বাদ সাধেন বিনফোর্ড, তিনি আগের এসব বিষয়কে নাকচ করে দিয়ে সংস্কৃতিকে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখার কথা বলেন, যেখানে পরিবেশের ভূমিকাও অনেক গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। ফলে পুকুর কাটা বা কবর খোঁড়ার গর্ত করা আর প্রয়োজনীয় বস্তুর আলোকে ইচ্ছামতো তৈরি করা ইতিহাস রচনার মাধ্যমে কোনো জনগোষ্ঠীর অতীতকে খেলো করার পথে অনেকটা কাঁটা বিছিয়ে দিয়ে ইউরোপীয় প্রত্নতাত্তি্বকদের চক্ষুশূল হন বিনফোর্ড। তারা বিনফোর্ডের প্রবর্তিত ঘরানাকে অনেকটা হাস্যকর প্রতিপন্ন করে নব্য ধারার প্রত্নচর্চা বলে নামকরণ করে। নতুন প্রজন্মের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও নৃবিজ্ঞানের গবেষকদের কাছে বিনফোর্ড একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাদৃত।
লেখক: মোঃ আদনান আরিফ সালিম অর্ণব
শিক্ষার্থী প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
aurnabmaas@gmail.com

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ


আদনান আরিফ সালিম
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া বেনাপোল থেকে তামাবিল_ এই ছোট্ট ভূখণ্ডের অতীত যে কত সমৃদ্ধ তা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিকল্প নেই

গত ৩০ মে দৈনিক সমকালের উপসম্পাদকীয়তে আবু সাঈদ খানের ‘পুরাকীর্তি ধ্বংসের প্রক্রিয়া রুখতে হবে’ শিরোনামে লেখাটি পড়লাম। তিনি যতটা না পুরাতাত্তি্বক দৃষ্টিকোণ থেকে, তার থেকে অনেক বেশি স্বাধীন বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে দেশের পুরাতাত্তি্বক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতামূলক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
এ অর্থে তিনি অবশ্যই একান্ত কৃতজ্ঞতা ও সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার।
আবু সাঈদ খান বলতে চেয়েছেন, নতুন প্রজন্মকে অতীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আমাদের সভ্যতা ও ঐতিহ্যের আবিষ্কার এবং সংরক্ষণে আজ ব্যাপক উদ্যোগ প্রয়োজন। আমি তার সঙ্গে এ ব্যাপারে পুরোপুরি ঐকমত্য পোষণ করে বিনয়ের সঙ্গে আরও কিছু বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমাদের দেশের প্রচলিত পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনটি দুর্বলতার কারণে বর্তমানে একটি অকার্যকর আইনে পরিণত হয়েছে। এখানে কিছু বিধিনিষেধ প্রকৃত অর্থে আইনের ফাঁকে পুরাকীর্তির ধ্বংসকেই বৈধতা দিয়েছে। অন্যদিকে জনসচেতনতার অভাব, ধর্মীয় গোঁড়ামি ইত্যাদি দেশের প্রত্নতাত্তি্বক ঐতিহ্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। একটি গোষ্ঠী হজরত শাহ সুলতান মাহী সওয়ারের মাজারকেন্দ্রিক লালসালু আখ্যানের বাস্তব রূপায়ণে মহাস্থানগড়ের বিরল প্রত্ননিদর্শন একের পর এক বিনষ্ট করে যাচ্ছে। পাহাড়পুরের মতো বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন এখন গোচারণভূমি। গুপ্ত যুগের নিদর্শন ভরত ভায়নাতেও একই হারে চলছে ধ্বংসযজ্ঞ। ময়নামতির শালবন বিহারের প্রত্নস্থলের ভেতরে এখন সিনেমার শুটিং হয়। একদিন লালবাগ কেল্লায় গিয়ে মহাসমারোহে প্রত্নস্থানের মধ্যেই শুটিং হতে দেখলাম।
আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে, আমরা নিজেরাই আমাদের ঐতিহ্যের রূপকার। আর ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে এটা স্পষ্ট হয়, আমাদের সংস্কৃতি কোনো বহিঃশক্তির কাছে প্রাপ্ত বা ধার করা নয়, নিজেদের সৃষ্টি। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে নিদর্শনগুলো আবিষ্কৃত হওয়ার পর আজ আর কোনো সংশয় নেই যে, যিশুর জন্মেরও বহুদিন আগে বাংলায় আমাদের পূর্বপুরুষরা সভ্যতার আলোকবর্তিকা প্রজ্বলনে সক্ষম হয়েছিলেন। কালের পরিক্রমায় ক্রমাগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে এসেছে আজকের বাংলাদেশিদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি কখনও কখনও বিভিন্ন অপশক্তির করাল গ্রাসে তার ঔজ্জ্বল্য হারালেও একেবারে দীপ্তিহীন হয়ে যায়নি।
আমাদের নিজেদের অতীত সম্পর্কে আমরা যদি জানতে চেষ্টা করি, যদি গণসচেতনতা তৈরি করা সম্ভব হয় তবেই আমাদের হাজার বছরের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করতে পারব। তবে প্রভাবশালী মহল, শিক্ষিত স্বার্থান্বেষী মহলের পাশাপাশি কিছু ব্যক্তির স্বার্থে রাষ্ট্রযন্ত্রই যখন পুরাকীর্তি ধ্বংসের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়, পরিস্থিতি তখন সত্যিই তা এক ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করে। আবু সাঈদ খান তার প্রবন্ধে ময়নামতির পুরাকীর্তি ধ্বংস করে সেই ইট খুলে সরকারি ভবন নির্মাণের কথা উল্লেখ করেছেন, যা হরহামেশাই ঘটছে। সাম্প্রতিক কিছু মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে বগুড়ায় জেলা প্রশাসক কর্তৃক মোগল মসজিদ সম্প্রসারণ, বাগেরহাটে খানজাহান আলীর মাজার ঘেঁষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্ত্রীর কবর তৈরি, স্থানীয় সাংসদ কর্তৃক খানজাহান আলী মাজারসংলগ্ন পুকুরটি আধুনিক টাইলস দিয়ে মোড়ানো, মহাস্থানগড়ের পুরাকীর্তি ধ্বংস করে সেখানে মাজার সম্প্রসারণ, জৈন্তাপুরের মেগালিথিক সমাধির পাথর নিয়ে গিয়ে খাসিয়া পল্লীতে বাড়ির সিঁড়ি তৈরি, ভরত ভায়নায় ইট চুরি, ময়নামতিতে ইট চুরি, প্রত্নস্থানে নাটক-সিনেমার শুটিং করা প্রভৃতি। পুরাকীর্তি সংস্কারের নামে যখন ধ্বংসলীলা চালানো হয় তার পরিণাম আরও ভয়াবহ। পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনকে অনেকে সময় বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রাচীন কীর্তির ওপরেই তাঁবু খাটানো, সংরক্ষিত এলাকায় অফিস, রেস্ট হাউস, বাসভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আবার সংরক্ষণ ও উৎখননে যোগ্য ব্যক্তির নিয়োগ না করা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকায় পুরাকীর্তি ধ্বংসের মাধ্যমে ঐতিহ্যের বিকৃতি ঘটছে। আমাদের দেশের জাতীয় জাদুঘরে কোনো প্রশিক্ষিত প্রত্নতাত্তি্বক নেই। দেশের একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক প্রত্নতত্ত্ব শিক্ষাদান করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে জাদুঘর বিদ্যা মৌলিক অংশ হিসেবে কোর্স শিরোনামে উল্লেখ থাকলেও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে পাস করে বের হওয়া ছাত্রছাত্রীদের দেশের জাদুঘরগুলোতে উপেক্ষিতই রাখা হয়।
আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে এমনি বিভিন্ন জাদুঘরে কী পরিমাণ পুরাকীর্তি রয়েছে, তার হিসাব প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে নেই। বেশিরভাগ অরক্ষিত নিদর্শনের কথা বাদ দিলেও জাদুঘরে রাখা নিদর্শনগুলোকে যথাযথ নিরাপত্তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। আবু সাঈদ খান উলি্লখিত বিষয়ের সঙ্গে আমি যোগ করতে চাই (সমকাল, ২৯ মার্চ ২০১১-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন), জাতীয় জাদুঘর থেকে ১৬টি নিদর্শন খোয়া যাওয়ার পাশাপাশি বিগত ৩০ বছরে হারিয়েছে ১৭২টি নিদর্শন, যার কোনো স্পষ্ট তালিকাও পাওয়া যায়নি। প্রশাসনিকভাবে দুর্বল দু’বছরের জন্য দেশের গণতন্ত্র হত্যাকারী ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন গংয়ের অরাজকতার শাসনকালে প্যারিসের গিমে জাদুঘরে দেশের ১৮৭টি পুরাকীর্তি পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে দেশের সংস্কৃতি সচেতন মানুষ প্রায় সবাই এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। ফলে সেখানে পাঠানো ৪২টি নিদর্শন ফেরত আনা হলেও জাতির কাছে একটা বিষয় আজও ধোঁয়াচ্ছন্নই রয়ে গেছে_ ফেরত আনা নিদর্শনগুলো আসল, না নকল!
আমাদের জাতীয় পরিচয়কে তুলে ধরতে গেলে সভ্যতা ও ঐতিহ্যের আবিষ্কার এবং সংরক্ষণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। প্রশিক্ষিত প্রত্নতাত্তি্বক, ভূতাত্তি্বক, প্রত্ন সংরক্ষণবিদ, প্রত্ন রসায়নবিদ, ভূ-প্রত্নতাত্তি্বক, দূর-অনুধাবন ও জরিপ বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন বিষয়ের অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিদের সহায়তায় আমাদের দেশের বৈচিত্র্যময় এই সাংস্কৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ সম্ভব। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, বেনাপোল থেকে তামাবিল_ এই ছোট্ট ভূখণ্ডের অতীত যে কত সমৃদ্ধ তা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে দেশের সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা একান্তভাবে কাম্য। পাশাপাশি দেশের মানুষকে যদি ঐতিহ্য-সচেতন করে তোলা যায়, তবে সরকারের কাজটি আরও সহজ ও সাবলীল হবে বলেই বিশ্বাস।

মোঃ আদনান আরিফ সালিম : শিক্ষার্থী, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 
Aurnab arc