সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ


গত ৩০ মে দৈনিক সমকালের উপসম্পাদকীয়তে আবু সাঈদ খানের ‘পুরাকীর্তি ধ্বংসের প্রক্রিয়া রুখতে হবে’ শিরোনামে লেখাটি পড়লাম। তিনি যতটা না পুরাতাত্তি্বক দৃষ্টিকোণ থেকে, তার থেকে অনেক বেশি স্বাধীন বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে দেশের পুরাতাত্তি্বক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতামূলক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এ অর্থে তিনি অবশ্যই একান্ত কৃতজ্ঞতা ও সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার।
আবু সাঈদ খান বলতে চেয়েছেন, নতুন প্রজন্মকে অতীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আমাদের সভ্যতা ও ঐতিহ্যের আবিষ্কার এবং সংরক্ষণে আজ ব্যাপক উদ্যোগ প্রয়োজন। আমি তার সঙ্গে এ ব্যাপারে পুরোপুরি ঐকমত্য পোষণ করে বিনয়ের সঙ্গে আরও কিছু বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমাদের দেশের প্রচলিত পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনটি দুর্বলতার কারণে বর্তমানে একটি অকার্যকর আইনে পরিণত হয়েছে। এখানে কিছু বিধিনিষেধ প্রকৃত অর্থে আইনের ফাঁকে পুরাকীর্তির ধ্বংসকেই বৈধতা দিয়েছে। অন্যদিকে জনসচেতনতার অভাব, ধর্মীয় গোঁড়ামি ইত্যাদি দেশের প্রত্নতাত্তি্বক ঐতিহ্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। একটি গোষ্ঠী হজরত শাহ সুলতান মাহী সওয়ারের মাজারকেন্দ্রিক লালসালু আখ্যানের বাস্তব রূপায়ণে মহাস্থানগড়ের বিরল প্রত্ননিদর্শন একের পর এক বিনষ্ট করে যাচ্ছে। পাহাড়পুরের মতো বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন এখন গোচারণভূমি। গুপ্ত যুগের নিদর্শন ভরত ভায়নাতেও একই হারে চলছে ধ্বংসযজ্ঞ। ময়নামতির শালবন বিহারের প্রত্নস্থলের ভেতরে এখন সিনেমার শুটিং হয়। একদিন লালবাগ কেল্লায় গিয়ে মহাসমারোহে প্রত্নস্থানের মধ্যেই শুটিং হতে দেখলাম।
আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে, আমরা নিজেরাই আমাদের ঐতিহ্যের রূপকার। আর ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে এটা স্পষ্ট হয়, আমাদের সংস্কৃতি কোনো বহিঃশক্তির কাছে প্রাপ্ত বা ধার করা নয়, নিজেদের সৃষ্টি। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে নিদর্শনগুলো আবিষ্কৃত হওয়ার পর আজ আর কোনো সংশয় নেই যে, যিশুর জন্মেরও বহুদিন আগে বাংলায় আমাদের পূর্বপুরুষরা সভ্যতার আলোকবর্তিকা প্রজ্বলনে সক্ষম হয়েছিলেন। কালের পরিক্রমায় ক্রমাগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে এসেছে আজকের বাংলাদেশিদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি কখনও কখনও বিভিন্ন অপশক্তির করাল গ্রাসে তার ঔজ্জ্বল্য হারালেও একেবারে দীপ্তিহীন হয়ে যায়নি।
আমাদের নিজেদের অতীত সম্পর্কে আমরা যদি জানতে চেষ্টা করি, যদি গণসচেতনতা তৈরি করা সম্ভব হয় তবেই আমাদের হাজার বছরের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করতে পারব। তবে প্রভাবশালী মহল, শিক্ষিত স্বার্থান্বেষী মহলের পাশাপাশি কিছু ব্যক্তির স্বার্থে রাষ্ট্রযন্ত্রই যখন পুরাকীর্তি ধ্বংসের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়, পরিস্থিতি তখন সত্যিই তা এক ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করে। আবু সাঈদ খান তার প্রবন্ধে ময়নামতির পুরাকীর্তি ধ্বংস করে সেই ইট খুলে সরকারি ভবন নির্মাণের কথা উল্লেখ করেছেন, যা হরহামেশাই ঘটছে। সাম্প্রতিক কিছু মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে বগুড়ায় জেলা প্রশাসক কর্তৃক মোগল মসজিদ সম্প্রসারণ, বাগেরহাটে খানজাহান আলীর মাজার ঘেঁষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্ত্রীর কবর তৈরি, স্থানীয় সাংসদ কর্তৃক খানজাহান আলী মাজারসংলগ্ন পুকুরটি আধুনিক টাইলস দিয়ে মোড়ানো, মহাস্থানগড়ের পুরাকীর্তি ধ্বংস করে সেখানে মাজার সম্প্রসারণ, জৈন্তাপুরের মেগালিথিক সমাধির পাথর নিয়ে গিয়ে খাসিয়া পল্লীতে বাড়ির সিঁড়ি তৈরি, ভরত ভায়নায় ইট চুরি, ময়নামতিতে ইট চুরি, প্রত্নস্থানে নাটক-সিনেমার শুটিং করা প্রভৃতি। পুরাকীর্তি সংস্কারের নামে যখন ধ্বংসলীলা চালানো হয় তার পরিণাম আরও ভয়াবহ। পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনকে অনেকে সময় বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রাচীন কীর্তির ওপরেই তাঁবু খাটানো, সংরক্ষিত এলাকায় অফিস, রেস্ট হাউস, বাসভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আবার সংরক্ষণ ও উৎখননে যোগ্য ব্যক্তির নিয়োগ না করা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকায় পুরাকীর্তি ধ্বংসের মাধ্যমে ঐতিহ্যের বিকৃতি ঘটছে। আমাদের দেশের জাতীয় জাদুঘরে কোনো প্রশিক্ষিত প্রত্নতাত্তি্বক নেই। দেশের একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক প্রত্নতত্ত্ব শিক্ষাদান করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে জাদুঘর বিদ্যা মৌলিক অংশ হিসেবে কোর্স শিরোনামে উল্লেখ থাকলেও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে পাস করে বের হওয়া ছাত্রছাত্রীদের দেশের জাদুঘরগুলোতে উপেক্ষিতই রাখা হয়।
আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে এমনি বিভিন্ন জাদুঘরে কী পরিমাণ পুরাকীর্তি রয়েছে, তার হিসাব প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে নেই। বেশিরভাগ অরক্ষিত নিদর্শনের কথা বাদ দিলেও জাদুঘরে রাখা নিদর্শনগুলোকে যথাযথ নিরাপত্তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। আবু সাঈদ খান উলি্লখিত বিষয়ের সঙ্গে আমি যোগ করতে চাই (সমকাল, ২৯ মার্চ ২০১১-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন), জাতীয় জাদুঘর থেকে ১৬টি নিদর্শন খোয়া যাওয়ার পাশাপাশি বিগত ৩০ বছরে হারিয়েছে ১৭২টি নিদর্শন, যার কোনো স্পষ্ট তালিকাও পাওয়া যায়নি। প্রশাসনিকভাবে দুর্বল দু’বছরের জন্য দেশের গণতন্ত্র হত্যাকারী ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন গংয়ের অরাজকতার শাসনকালে প্যারিসের গিমে জাদুঘরে দেশের ১৮৭টি পুরাকীর্তি পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে দেশের সংস্কৃতি সচেতন মানুষ প্রায় সবাই এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। ফলে সেখানে পাঠানো ৪২টি নিদর্শন ফেরত আনা হলেও জাতির কাছে একটা বিষয় আজও ধোঁয়াচ্ছন্নই রয়ে গেছে_ ফেরত আনা নিদর্শনগুলো আসল, না নকল!
আমাদের জাতীয় পরিচয়কে তুলে ধরতে গেলে সভ্যতা ও ঐতিহ্যের আবিষ্কার এবং সংরক্ষণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। প্রশিক্ষিত প্রত্নতাত্তি্বক, ভূতাত্তি্বক, প্রত্ন সংরক্ষণবিদ, প্রত্ন রসায়নবিদ, ভূ-প্রত্নতাত্তি্বক, দূর-অনুধাবন ও জরিপ বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন বিষয়ের অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিদের সহায়তায় আমাদের দেশের বৈচিত্র্যময় এই সাংস্কৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ সম্ভব। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, বেনাপোল থেকে তামাবিল_ এই ছোট্ট ভূখণ্ডের অতীত যে কত সমৃদ্ধ তা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে দেশের সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা একান্তভাবে কাম্য। পাশাপাশি দেশের মানুষকে যদি ঐতিহ্য-সচেতন করে তোলা যায়, তবে সরকারের কাজটি আরও সহজ ও সাবলীল হবে বলেই বিশ্বাস।

One thought on “সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ”

মন্তব্য করুন