গারো নৃ-গোষ্ঠীর কৃত্যনির্ভর জীবন ও আচার


image_1324_368779বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যরা সুদীর্ঘকাল যাবৎ বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজস্ব জাতিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে। হাজার বছরের সহাবস্থান সত্ত্বেও তারা আত্মপরিচয় বিসর্জন দিয়ে বাঙালির ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি পূর্ণ আকৃষ্ট হয়নি। জাতীয়তা, স্বকীয়তা তাদের ব্যবহারিক জীবনের সব কর্মেই আজও পরিলক্ষিত হয়। সমৃদ্ধ সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী গারো নৃ-গোষ্ঠীরও রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান।
ভাওয়ালের গড়ের ভিন্ন ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে ওঠা অরণ্যে গারো নৃ-গোষ্ঠীর পুরুষানুক্রমিক বাস। প্রাচীন ও মধ্যযুগে এই অরণ্যচারী মানুষের পেশা ছিল মূলত পশু শিকার। অরণ্য কেটে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি ও কৃষিকর্মে আত্মনিয়োগ করে তারা। জুম পদ্ধতির চাষ দিয়েই তাদের কৃষি যুগের সূচনা। মৎস্য শিকার, কচ্ছপ, কুইচ্ছা, কাঁকড়া, শূকর, খরগোস, বনরুই, ঘুঘু, হরিয়াল ও বনমোরগ শিকার ছিল তাদের পেশার অন্তর্গত। মূলত মাতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর ভেতর থেকে ধীরে ধীরে সামন্ত অর্থনীতির স্তরে উন্নীত হয়। বস্তুত মূল ভূখণ্ডের রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে সাম্প্রতিককালে গারো নৃ-গোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থারও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
গারো নৃ-গোষ্ঠী সর্বপ্রাণবাদী। খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করার আগে তাদের আদি ধর্মের নাম ছিল সাংসারেক। এই সাংসারেক গারো নৃ-গোষ্ঠী সর্বপ্রাণবাদী। তারা বাস্তুভিটার পূজা করে, ফসলের ভাণ্ডারের পূজা করে, ঘরের খুঁটির পূজা করে। এমনিভাবে সব কিছুতেই তারা প্রাণের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে তাদের দৈনন্দিন ক্রিয়া-কর্ম, উৎপাদন ও জীবন-সংগ্রাম পরিচালিত করে। গারো জাতির আদি ধর্ম প্রসঙ্গে Major A. Playfair তাঁর The Garos গ্রন্থে বলেছেন-
Like all animistic religions, that of the Garo consists of the belief in a multitude of beneficent and malevolent spirits. To some is attributed the creation of the world, to others the control of nature phenomena; and destinies of man from birth to death are governed by a host of divinities whose anger must be appeared and whose good offices must be entreated in like manner.
অর্থাৎ গারোদের আদি ধর্ম Animistic। Animistic বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন উপকারী ও অনিষ্টকারী বহু উপদেবতায় বিশ্বাস। এই বিশ্বাসকে ঘিরেই গারো নৃ-গোষ্ঠীর জীবনে অসংখ্য কৃত্য বা Ritual বিদ্যমান। তাদের রয়েছে একটি সমৃদ্ধ মিথ (Myth) বা পুরাণ। বিশ্বসৃষ্টির ইতিহাস, মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস, পৃথিবীর জন্ম ও মানুষের বসবাসসংক্রান্ত পুরাণকাহিনী। এমনকি নৃত্য-গীত-বাদ্যেরও স্বতন্ত্র দেবতা ও পুরাণ বিদ্যমান। অন্য অনেক আদিম জাতির মতোই গারো নৃ-গোষ্ঠী সূর্যপূজাকে সর্বোচ্চ কৃত্য বা Ritual গণ্য করে। সূর্য বা সালজং দেবতা তাদের জীবনের যেকোনো প্রতিকূল অবস্থার আশ্রয়স্থল। ‘নস্তু-নপান্তু’ গারো নৃ-গোষ্ঠীর আরেক দেবতা। ‘তাতারা রাবুগা’ গারো নৃগোষ্ঠীর পুরাণ অনুযায়ী বিশ্বস্রষ্টা। গারো নৃগোষ্ঠীর বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের সৃষ্টিতত্ত্বের মিথ (Myth) বা পুরাণ কাহিনীটি নিম্নরূপ-
“সৃষ্টির আদি অবস্থায় বিশ্বজগৎ বলতে কিছুই ছিল না। এই পৃথিবীর চারদিকে তখন নিঃসীম কালো ঘোর-অন্ধকার ও অসীম জলরাশিতে পরিপূর্ণ ছিল। চারদিকে কেবল পানি আর পানি ছাড়া কোথাও আলো, ভূমি, প্রাণী বা গাছপালার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এ অবস্থায় তাতারা-রাবুগা পৃথিবী সৃষ্টি করার কথা চিন্তা করলেন। তাঁর এই জাগ্রত ইচ্ছাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য তিনি তাঁর সহকারী দেবতা নস্তু-নপান্তুকে মনোনীত করলেন। নস্তু-নপান্তু একজন স্ত্রীলোকের বেশে তাঁর সহকর্মী ‘মাচি’র সহায়তায় পৃথিবী সৃষ্টির কাজে মনোনিবেশ করলেন।”
নস্তু-নপান্তু প্রথমে পানির ওপর বিছানো মাকড়সার জালে আশ্রয় নিলেন। তাতারা-রাবুগা পৃথিবী সৃষ্টি করার জন্য তাঁর হাতে এক মুঠো বালি দিয়েছিলেন। নস্তু-নপান্তু সেই এক মুঠো বালি দিয়ে প্রথমে পৃথিবীর আকার তৈরি করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনোমতেই তিনি তা একত্র করতে পারলেন না। ওই কাজে তাঁকে সাহায্য করার জন্য কর্কটাকৃতির অতিকায় এক প্রাণীকে তিনি গভীর পানির তলদেশ থেকে কিছু কাদামাটি নিয়ে আসার জন্য প্রেরণ করলেন। কিন্তু পানির গভীরতা খুব বেশি থাকায় তার পক্ষে মাটি নিয়ে আসা সম্ভব হলো না। কাজেই সে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এলো। সবশেষে নস্তু-নপান্তু ‘চিচিং-বারচিং’ নামক ছোট এক প্রাণীকে ওই কাজে নিযুক্ত করলেন। চিচিং-বারচিং গভীর পানির তলদেশে প্রবেশ করে কিছু কাদামাটি নিয়ে ফিরে এলো। আর সেই কাদামাটির সাহায্যে নস্তু-নপান্তু তখন এই পৃথিবী সৃষ্টি করলেন।
নস্তু-নপান্তু পৃথিবী সৃষ্টি করে এর নাম দিলেন ‘মানোপিল্টো’। পৃথিবীর বৃহদাকৃতির পাথর ‘মজার’ আর ছোট আকৃতির পাথর ‘ডিনজার’ ছাড়াও পৃথিবীর উপরিভাগ তখনো খুবই নরম ছিল। এর ওপর দিয়ে হাঁটা ছিল তখন অসম্ভব। এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করার জন্য নস্তু-নপান্তু তাতারা-রাবুগাকে অনুরোধ করলেন। তাতারা-রাবুগা নস্তু-নপান্তুর প্রার্থনা শুনে আকাশে সূর্য ও চন্দ্র দিলেন এবং মর্তে দিলেন বাতাস। সূর্যের আলো, চন্দ্রের কিরণ এবং মর্তের বাতাসে পৃথিবীর উপরিভাগ ধীরে ধীরে শক্ত ও কঠিন হয়ে উঠল।
তাতারা-রাবুগা পৃথিবীকে একটি অন্তর্বাস দান করলেন। তিনি মেঘের তৈরি একটি ‘পাগড়ি’ও তার মাথায় পরালেন। মাথায় চুলের শোভা বৃদ্ধির জন্য তিনি তার মাথায় ‘আমফাং’, ‘প্রাপ’ বৃক্ষের মূলের মতো তার মাথায় চুলও দান করলেন। প্রাণীদের মধ্যে তাতারা-রাবুগা প্রথমে লেজবিহীন বানর-জাতীয় একটি প্রাণীকে সৃষ্টি করেন। এই প্রাণীর কাজ ছিল তার বিকট আওয়াজ দ্বারা পৃথিবীকে সচল ও সজাগ করে রাখা। বিশ্ব প্রকৃতি যাতে ক্লান্তিতে অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় ঝিমিয়ে না পড়ে তার যাবতীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেই প্রাণীকে। এরপর তিনি হনুমান ও বাদামি রঙের বানর সৃষ্টি করেন। একইভাবে পরে অন্যান্য প্রাণী সৃষ্টি করেন তিনি।
জলচর প্রাণীর মধ্যে প্রথমে তিনি একটি বৃহদাকৃতির কদাকার ব্যাঙকে সৃষ্টি করলেন। এই ব্যাঙের কাজ ছিল তার বিকট আওয়াজ দ্বারা অন্য জলচর প্রাণীর কাছে আকাশে মেঘের আগমন বার্তা ঘোষণা করা। ব্যাঙ সৃষ্টির পর তিনি গভীর জলের অন্য মাছগুলো সৃষ্টি করেন। পৃথিবী সৃষ্টির পর তাতারা-রাবুগা দেখতে পেলেন মাটির নিচে অনেক পানি আছে। কিন্তু পৃথিবীর উপরিভাগে কোথাও এক ফোঁটা পানি নেই। তখন তিনি পৃথিবীর বুকে নদী প্রবাহিত করলেন। কঠিন এই ধরার বুকে বারিধারা সিঞ্চনের নিমিত্ত তিনি আকাশে ‘নরে-চিরে-কিম্রে-বক্রে’ নাম্নি বৃষ্টিদেবীকে পাঠালেন। আকাশে বৃষ্টির আগমন বার্তা ঘোষণা করার জন্য তিনি ‘গোয়েরা’ (বজ)কেও পাঠালেন।
তাতারা-রাবুগা পৃথিবীর সব কিছু সৃষ্টির অব্যবহিত পর সৃষ্টি করলেন ‘মানুষ’। আদি গারো ধর্মে বিশ্বাসীদের মতে, প্রথম মানব-মানবীর নাম হলো ‘শানী’ ও ‘মুনি’। তাতারা-রাবুগার আদেশে তাতারা-রাবুগা প্রাচ্যের ‘আমিতিং-আফিল্জাং’ নামক কোনো এক স্থানে গারোদের আদি পিতা-মাতা ও প্রথম নারী-পুরুষ এই শানী ও মুনিকে সৃষ্টি করেন। তাদের সন্তানদের নাম হলো ‘গানচেং’ আর ‘দুজং’। এই গানচেং এবং দুজংই হলো বর্তমান গারো জাতির পূর্বপুরুষ। বর্ণিত উপাখ্যানে সাংসারেক গারোদের নিম্নবর্ণিত দেবদেবীর অস্তিত্ব স্বীকৃত- পৃথিবী সৃষ্টির দেবতা তাতারা-রাবুগা বিশ্ব সৃষ্টিতে সাহায্যকারী দেবতা নস্তু-নপান্তু, নস্তু-নপান্তুর সহায়তাকারী মাচি; যিনি প্রকৃত প্রস্তাবে গারোদের প্রথম নারী দেবতা। নরে-চিরে-কিমরে-বকরে বৃষ্টির দেবতা, সালজং সূর্যের দেবতা এবং গোয়েরা বজ্রপাতের দেবতা। সাংসারেক গারোদের মধ্যে এসব দেবতাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কৃত্য বা Ritual আজ অবধি প্রচলিত। প্রতিটি কৃত্য বা Ritual-এর রয়েছে সুনির্দিষ্ট আচার-উপাচার ও সময়।
প্রতিটি গারো নৃ-গোষ্ঠীর সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কিত পূর্বোক্ত উপাখ্যান ব্যতিরেকেও অন্য একটি উপাখ্যানের সাক্ষাৎ মেলে। কাহিনীগত ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও এই নৃ-গোষ্ঠীর আদি ধর্ম সাংসারেকপন্থীদের মতে তাতারা-রাবুগা সৃষ্টিকর্তা এবং নস্তু-নপান্তু তাঁর সহযোগী। উপরোক্ত দেবতাদ্বয়ের পরই সূর্যদেবতা সালজং-এর স্থান। সাংসারেক গারোদের বিশ্বাস মতে, পৃথিবীতে চাষাবাদের প্রবর্তন করে ‘বনজাসকো’ এবং তার স্ত্রী ‘জানেগানদো’। তারাই দেবতার সন্তুষ্টি বিধানের নিমিত্তে উৎপন্ন ফসলের একটি অংশ দেবতার নামে উৎসর্গ করে। কার্যত এ পূজার উপলক্ষ সূর্যদেবতা সালজং। এই সালজংই গারো সাংসারেকদের কৃষিদেবতা। দ্রাবিড় গোষ্ঠীর সূর্যপূজা ‘ইন্কা ও পেরুর’ সূর্যপূজা মিসর ও মেসোপটিয়াম সভ্যতার সূর্যপূজা একই আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতকেই নির্দেশ করে। এই সূর্যপূজার অনুষঙ্গেই সাংসারেক ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে Nature Worship এবং Fetishism-এর প্রচলন ঘটে।
গারো নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতির সিংহভাগজুড়ে আছে এই ‘Nature Worship এবং Fetish Worship। শিকার ও কৃষিজীবী গারো নৃ-গোষ্ঠী জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে সর্ববস্তুতে তাদের ঈশ্বরের উপস্থিতি জেনে সে মতো আচরণ করে থাকে। বলা যায়, তাদের জীবন মূলত কৃত্য বা Ritual সর্বস্ব। একদিকে গারোদের ধর্মের সঙ্গে বহু পুরাণ কাহিনী সংযোগ রয়েছে আর অন্যদিকে জীবহত্যা, নৃত্যানুষ্ঠান ও মদ্যপান ইত্যাদি তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ‘ওয়ানগাল্লা’ নামক উৎসবটিকে তারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। এটি তাদের ফসলের উৎসব- বাঙালির নবান্নের মতো। ওয়ানগাল্লায় কৃষি, ফসল সম্পর্কিত সব দেবতার কৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। গারোরা পুনর্জন্মে বিশ্বাসী।
ঐতিহ্যগতভাবে তারা যে অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করে থাকে, এর নাম হলো ‘মিতে’ বা ‘মাইতে’। গারোদের ধারণা, কিছু মাইতে আছে যারা খুব দয়ালু ও পরোপকারী; আবার কিছু মাইতে অনেক নির্দয় ও শত্রুভাবাপন্ন থাকে। সার্বিকভাবে গারোরা এক সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী; তবে প্রকৃতিকে উপলব্ধি করতে গিয়ে পাহাড়-পর্বত, চন্দ্র-সূর্য, নদী-নালা ইত্যাদির পূজাও আয়োজন করে থাকে। অর্থাৎ তাদের ধর্মকে জড়োপাসনা বা ভূতপূজা বা প্রেতবাদ বলেও উল্লেখ করা যায়। তাদের মধ্যে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে পূজা প্রচলিত থাকায় তাদের একান্ত বিশ্বাস হলো, মৃত আত্মার পূজা করলে ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। গারোরা হিন্দুদের মতো বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা-পার্বণের আয়োজন করে থাকে। তারা বিশ্বাস রাখে যে ভালো কাজ করলে এবং পুণ্যের সাধনা করলে আত্মা ঋষি বা মানুষ হয়ে আবার জন্মগ্রহণ করে। আর অসৎকর্ম করলে তার আত্মা পিশাচ হয়ে বা নানা রকম পশুপাখি হয়ে আবার জন্মগ্রহণ করে। তাই তাদের মধ্যে আত্মা-মূর্তি স্থাপনের প্রথাও প্রচলিত রয়েছে। গারো নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে যারা পরবর্তীকালে ধর্মান্তরিত হয়েছে তারা সাংসারেক ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। বর্তমানে তারা খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী।
সাংসারেক গারোরা খ্রিস্টীয় গারো অপেক্ষা স্বতন্ত্র ধারায় জীবনবাহিত করে। তাদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। মা তাঁর সন্তানদের মধ্য থেকে তাঁর পছন্দমতো এক কন্যাকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। মাতৃতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য তাদের আদিম জীবনযাত্রার পরিচয়জ্ঞাপক। সমাজ বিকাশের ধারায় আদি কৃষিজীবী সমাজে নারীকে কেন্দ্র করে সমাজ গড়ে ওঠে। নারী ছিল সেই অবিকশিত সমাজকে টিকিয়ে রাখার কেন্দ্রশক্তি। এ কারণে এককভাবে তিনি সম্পত্তির প্রকৃত মালিক। আধুনিক বিশ্বে যেসব মানবগোষ্ঠী পশ্চাৎপদ জীবন পরিচালনা করছে তাদের বেশির ভাগই মাতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর মধ্যে অবস্থান করে। গারো সমাজে নারী ও পুরুষ সম্মিলিতভাবে কায়িক শ্রমে অংশগ্রহণ করে। কর্মের পাশাপাশি বিনোদন হিসেবে যেমন তারা কৃত্য বা Ritual-গুলো পালন করে তেমনিভাবে সেগুলো তাদের জীবিকা ও ধর্মের সঙ্গেও যুক্ত। ফলে কৃত্য বা Ritual থেকে তাদের আলাদা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গারো নৃ-গোষ্ঠীর কৃত্য বা Ritual-গুলোর ধারাবাহিক আলোচনা উপস্থাপনেই বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে। নিম্নে এ রকম কিছু কৃত্য বা Ritual-এর পরিচয় উপস্থাপন করা হলো-
প্রাচীন মিসরীয় জীবন ও শস্যের দেবতা ওসিরিসের পূজা উৎসব উপলক্ষে সে দেশের নাট্যের উদ্ভব। প্রাচীন গ্রিসেও কৃষিদেবতা দাউনিসাসের কৃত্যমূলক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গ্রিক ট্র্যাজেডির উদ্ভব। একই ঘটনার অনুবর্তন ঘটে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে নাট্যের উদ্ভবের ক্ষেত্রে। সুতরাং কৃত্য বা Ritual হচ্ছে নাট্যের প্রাণকোষ। প্রকৃতি পূজক ও পাথর পূজক সাংসারেক গারো নৃ-গোষ্ঠী সংস্কৃতিতে Ritual বা কৃত্যের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বরং অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠী অপেক্ষা মাত্রাগতভাবে তা অধিকতর ক্রিয়াশীল। গারোদের ওয়ানগাল্লা কার্যত একটি ‘Fertility Ritual’। গারো সংস্কৃতিতে বিদ্যমান সব ধরনের নৃত্য-গীত-নাট্যের আধার এই ওয়ানগাল্লা। গারো মিথোলজির এক অত্যাশ্চর্য ‘কাহিনী অংশ’ হিসেবে ওয়ানগাল্লা অদ্যাবধি গারো সাংসারেকদের মধ্যে প্রচলিত। ওয়ানগাল্লা এই নৃ-গোষ্ঠীর নবান্ন অনুষ্ঠান। ওয়ানগাল্লা ছাড়া গারো নৃ-গোষ্ঠীর ‘Fertility Ritual-এর মধ্যে পড়ে- দেন বিলসিয়া, আচিরিক্কা বা আসিরকা, আগালমাকা, রংছুগাল্লা ‘জামেগাপ্পা’ আহাওয়া ইত্যাদি।
স্মর্তব্য যে গারো নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া অবিচ্ছিন্ন অর্থাৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে অন্বয়বিহীন কোনো সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম তাদের জীবনচর্চার অঙ্গীভূত নয়। পূর্বেই বলা হয়েছে, এদের সূর্যদেবতা সালজং প্রকৃতিকে উর্বরা শক্তি দান করে। বীজ থেকে অঙ্কুরোদগমের প্রক্রিয়ায় সুপুষ্ট ফসল ফলে তাঁরই লীলায়। তাঁরই সন্তুষ্টি বিধানের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হয় ওয়ানগাল্লা উৎসব। গ্রামপ্রধান (নকমা) পুরোহিত (খামাল/কামাল) এবং গ্রামবাসী সবার ঘরে তিন দিনব্যাপী চলে এই উৎসব। উৎসব চলাকালে তারা নিজেদের তৈরি ‘চু’ নামে এক ধরনের পানীয় পান করে। ধর্মীয় ও সামাজিক এ দুই পর্বে বিভক্ত অনুষ্ঠানটি রংদিকমিত্তি, নক্নি মিত্তি, খ্রংনা দথাত্তা, খ্রামনা দথাত্তা, মিত্তি দথাত্তা, নাগরা দথাত্তা, আংখি দথাত্তা ইত্যাদি দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গকৃত কৃত্যের মাধ্যমে সুসম্পন্ন করা হয়।
Fertility Ritual-এর মতো গারো নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত রয়েছে জন্মবিষয়ক কৃত্য। যেমন- গারো নৃ-গোষ্ঠীর পরিবারে সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর তারা সন্তানকে ঈষদোষ্ণ গরম পানি দিয়ে গোসল করায়। এরপর তারা ঘরের দরজায় জাল, ঘরের মাঝখানে আগুনের কুণ্ড ও সন্তানের শিয়রে পচা পাতা রেখে দেয়। এর কারণ গারোদের বিশ্বাস, এর ফলে নাকি অপদেবতারা নবজাতকের কোনোরূপ ক্ষতিসাধন করতে পারে না। সাধারণত সন্তান জন্মের সাত দিন পর তার নাম রাখা হয়। বস্তুত নবজাতকের কল্যাণের উদ্দেশ্যে তাকে নীরোগ রাখার অভিপ্রায়েই অনুষ্ঠিত হয় ওই জন্মবিষয়ক কৃত্য।
ফসল উৎপাদনের জন্য গারো নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা বছরে যেসব পূজা-পার্বণের আয়োজন করে থাকে, তার মধ্যে ‘আগাল মাকা’, ‘গিচিপং’, ‘মিচিল তাতা’, ‘রংচুগালা’, ‘ওয়াংলা’ ও ‘কাওকারা’ ইত্যাদি প্রধান। এসব পর্ব সাধারণত বীজ বোনা, ফসল তোলা ও নবান্ন প্রভৃতি অনুষ্ঠান পালন করার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এর মধ্যে ওয়াংলা উৎসব বা পূজাই তারা খুব বেশি ঘটা করে আয়োজন করে থাকে। ওয়াংলা পূজায় দুটি উদ্দেশ্য সাধন হয় বলে গারোরা বিশ্বাস করে। এক. ওয়াংলা পূজায় ফসলাদি পঙ্গপাল ও কীটপতঙ্গ প্রভৃতির মহামারি আক্রমণ থেকে রক্ষা পায় : দুই. জরা-ব্যাধি, মহামারি রোগ-শোক থেকেও নিজেরা মুক্তি পায়।
গারোরা ‘ওয়াংলা’ পূজার আয়োজনকালে ‘আসংতাতা’ নামের কোনো অদৃশ্য শক্তির কল্পনা করে থাকেন, যিনি তাদের নানারূপ বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেন। পূজার নিয়ম হলো-
প্রথমে বাঁশ দিয়ে একটি ঘোড়ার মূর্তি নির্মাণ করে গ্রামের কোনো সুনির্দিষ্ট স্থানে তা স্থাপন করা। এরপর পাঁঠা, বানর কিংবা ইঁদুর এই তিন প্রাণীর মধ্য থেকে যেকোনো একটিকে ওই প্রাণীর গলায় বেঁধে বা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় গ্রামসুদ্ধ প্রাণীটিকে ঘোরানো হয়। শেষমেশ দা দিয়ে ওই প্রাণীটিকে হত্যা করে ঘোড়ার মূর্তির পাশে বাঁশবিদ্ধ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। গারোদের বিশ্বাস, এ প্রাণীর হত্যা দর্শনে মহামারি রোগও ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। ফলে রোগ-ব্যাধি তাদের শরীরের ধারে-কাছে আসতে সাহস পায় না। এসব পুরাণের পাশাপাশি সাংসারেক গারো সমাজে কিছু বিশ্বাস ও সংস্কার প্রচলিত আছে। এগুলো তাদের দৈনন্দিন গার্হস্থ্য জীবনকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত করে থাকে। নিম্নে এরূপ আরো কিছু বিশ্বাস-সংস্কারের প্রসঙ্গ আলোচিত হলো-
সব সর্বপ্রাণবাদী গারোরা কিছু বিশ্বাস-সংস্কার দ্বারা পরিচালিত এবং প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রিত। বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে প্রাত্যহিক জীবনে তারা অনেক ঈর্ষাপরায়ণ দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। নির্বিঘ্ন জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষায় তাদের তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে নিবেদন করে নানাবিধ কৃত্য বা Ritual। অর্থাৎ আদিম জীবনের অনুষঙ্গ কৃত্য বা Ritual-সর্বস্ব করেছে গারোদের অস্তিত্বকে। যেসব আধিভৌতিক চেতনায় তারা বিশ্বাসী তাদের কেউ কেউ বিশ্ব সৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত, কেউ কেউ প্রাকৃতিক জগৎ পরিক্রমার গুরুদায়িত্বে নিয়োজিত। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যাবতীয় কর্মযজ্ঞে বহুসংখ্যক দেবতা নিয়োজিত যাদের ক্রোধ পূজার মাধ্যমে শান্ত করা সম্ভব এবং তাদের শুভ ও কল্যাণ ওই প্রক্রিয়ায় লাভ করা সম্ভব বলেই গারোরা বিশ্বাস করে।
গারো সমাজে মানুষের অস্তিত্বে আত্মা সম্পর্কে এ মত বিশ্বাস প্রচলিত যে মৃত্যুর পর মানবাত্মা তার পথে একটি নির্দিষ্ট স্থানে যাত্রা করে সেখানে একটি সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাস করে এবং আবার জীবিত হওয়ার আগে পর্যন্ত সেখানেই থাকে। তাদের বিশ্বাসে মৃত্যুর পর কোনোরূপ শাস্তি এবং তৎপরে কোনো পুরস্কার সম্পর্কিত ধারণা ও প্রত্যাশা অনুপস্থিত। পাপের জন্য একজনমের ফল পুনর্জন্মের নবরূপের মধ্য দিয়ে ভোগ করতে হবে। এ বিশ্বাসে স্বচ্ছতা বিদ্যমান। মর্ত্যপ্রীতিও এতে একই সঙ্গে বিধৃত। নবজন্মের সর্বনিম্ন রূপ এই যে পাপাত্মা বিভিন্ন পোকামাকড় ও প্রাণীর দেহে স্থান পাবে। রূপান্তরিত জীবনে মানুষের সর্বোচ্চ আকৃতি হবে বিভিন্ন বন্য প্রাণী, পাখি এবং তারপর লাভ করবে মানবাকৃতি। সৎ জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট পুরস্কার হবে আগের মাতৃগর্ভে জন্মলাভের অধিকার অর্জন। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে মায়ের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধাপ্রসূত চিন্তার ফলে ওই বিশ্বাস অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ। গারোদের প্রধান দেবতার সৃষ্টিসংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত পুরাণ কাহিনী অনুযায়ী তাদের প্রত্যেক দেবতার কিছু নামের বিষয়ে মনোযোগ দিলে এমন ধারণা হয় যে উদ্ভূত কিছু পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এ নামগুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাদের দীর্ঘ নাম বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে- অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা দুটি নামের সমন্বিত রূপ এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের মূল নামের সঙ্গে মা-বাবার নামের অংশ উপসর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
গারো নৃ-গোষ্ঠীর আরাধ্য দেবতাদের নামকরণ এবং ভূমিকা সম্পর্কিত আলোচনা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
১. তাতারা-রাবুগা (Tatara Rabuga) : তাতারা-রাবুগা জগৎ স্রষ্টা- তাঁর নির্দেশে দুজন অধস্তন দেবতা নস্তু-নপান্তু এবং মাচি। জগৎ সৃষ্টিকর্মে তারা তাঁকে সহায়তা করে। তিনি সর্বোৎকৃষ্ট ও শক্তিধর আত্মা হিসেবে সব কিছুর তদারক করেন। মানবকল্যাণ সম্বন্ধীয় চিন্তা তাঁর নিজের বিশেষ উদ্দেশ্যের অন্তর্গত। তিনি নানা ধরনের দুরারোগ্য অসুখ নিরাময় করে থাকেন। যেমন- কালাজ্বর এবং অন্য স্থায়ী জ্বরগুলো। তিনি অন্য আটটি নামে পরিচিত। যেমন- স্তরা পানতুরা, জিপজিনিজিপজানা, কুরাডুক-কুরাপিন, চানদাসি, গোনগোনগ্রিগিপা, বুলগিপা, ইমবানগগিপা, আজানজান, বুলজানজান, সেকিরা-বালিরা জামানক গিপা ও জানগিনি বিয়ামবি। তার উদ্দেশে নিবেদিত পূজা খুবই ব্যয়বহুল। একটি ষাঁড়, একটি ছাগল ও মোরগ-মুরগি অবশ্যই তাঁর সম্মানে হত্যা করা হয়। পূজারিরা দুই দিনব্যাপী মদ্যপানে নিমগ্ন থাকে। এবং তাদের খাবারের জন্য ভাতেরও ব্যবস্থা থাকে।
২. চুরাবুদি (Chorabudi) : চুরাবুদি একটি প্রসন্ন আত্মার দেবতা। তিনি ফসলের রক্ষাকর্তা। শস্য পরিপক্বতার আগে তার পূজার আয়োজন করে তার উদ্দেশে চাল, ময়দা, তরমুজ বা খেজুর উৎসর্গ করা হয়। অর্থাৎ যাবতীয় কৃষিজ দ্রব্যসামগ্রী তার পূজার উপকরণরূপে উৎসর্গ করাই বিধি। কানের ব্যথা এবং ফোড়া ইত্যাদি রোগজনিত বেদনানাশের জন্য তার পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তিনি তাতারা রাবুগার আজ্ঞাবহ। অন্য দেবতা মাচির সহযোগিতায় পৃথিবী তিনি সুসজ্জিত করেন। যখন তাতারা-রাবুগার উদ্দেশে পূজা নিবেদন করা হয় তখন চুরাবুদির উদ্দেশে অবশ্যই একটি শূকর উৎসর্গ করা হয়। মূলত কৃষি অর্থনীতিনির্ভর সমাজের গারো অধিবাসীরা চুরাবুদির ওপর আপন সন্তোষ প্রকাশ করতেই তার পূজানুষ্ঠানের আয়োজন করে।
৩. নস্তু-নপান্তু (Nostu-Nopantu) : নস্তু-নপান্তু সেই দেবতা, যিনি তাতারা রাবুগার আদেশে মাচির সহযোগিতায় পৃথিবীকে সুদৃশ্যরূপে তৈরি করেন। যেহেতু তারা মানুষের কোনো ক্ষতি করে না; সেহেতু নস্তু-নপান্তু ও মাচির উদ্দেশে কোনোরূপ পূজা অর্পণ করা হয় না। ব্যাখ্যাটি এমন হওয়াই বিধেয়- পৃথিবী সৃষ্টি ছাড়া তার কোনো ভূমিকা নেই। কোনো বিশেষ কর্মে নিয়োজিত নন বলেই তাঁকে পূজার কোনো আবশ্যকতা নেই।
৪. সালজং (Saljong) : সালজং হচ্ছে গারোদের উর্বরতার দেবতা। তিনি সূর্যের দ্বারা নিয়োগকৃত তারই প্রতিনিধি। তিনি পূজিত হন সর্বদাই। কারণ সব শস্যই তাঁর নিয়ন্ত্রণে এবং তাঁর সহানুভূতি ছাড়া কোনো কর্ষণকর্ম অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। কোনো জীবের অস্তিত্ব রক্ষা তাঁকে বাদ দিয়ে অসম্ভব। তাই সালজং অবশ্যপূজ্য দেবতা। গারোদের সর্ববৃহৎ বার্ষিক উৎসব ওয়ানগাল্লা তাঁর সম্মানেই উৎসর্গীকৃত। কিন্তু তাঁর উদ্দেশে প্রকৃত পূজা নিবেদিত হয় মাঠে, গ্রামে উৎসব অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে। একটি মোরগ হত্যা করে সেটির রক্ত উৎসর্গ বেদিতে ছিটানো হয়। সামান্য মদ এই বেদির বাইরে মাটিতে এর সম্মুখে রাখা হয়। তারপর পূজারিরা ওয়ানগাল্লা উৎসবে আনন্দ উপভোগের জন্য গ্রামে ফিরে আসে। এই দেবতা Tengsugipa-tengtotgipa, Salgiraa, Salgra, Ges rengra-balsa নামেও পরিচিত।
৫. গোয়েরা (Goera) : গোয়েরা হচ্ছে শক্তির দেবতা এবং বজ্র ও বিদ্যুতের উৎস বা কারণ। দীর্ঘ অসুস্থতার পরে স্বাস্থ্য ও শক্তির কামনায় তাঁর প্রার্থনা করা হয়। সব সময়ই গাছের শিকড়ে তাঁর পূজা উৎসর্গীকৃত হয়ে থাকে। একটি শূকর, একটি মোরগ-মুরগি অথবা একটি পাতিহাঁস তাঁর পূজায় নিবেদন করা হয়। যখন একটি গাছ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় বা মারা যায় তখন এরূপ বলা হয়, গোয়েরা একে আঘাত করেছেন। এই সময় ওই গাছের শিকড়ে এই উদ্দেশে পূজা প্রদান করা হয়, যাতে পার্শ্ববর্তী গৃহস্থদের কোনো ক্ষতি না হয়। এই দেবতার পূজার সঙ্গে অরণ্যাচারী গারোদের নৈমিত্তিক জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি যুক্ত।
৬. কালকামে (Kalkame) : কালকামে গোয়েরার ভাই। তিনি সেই দেবতা, যাঁর দুই হাতে সব মানুষের জীবন। আসুংতাতা বা আসুংরোকা উৎসবে তাঁর প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। পূজা উৎসব পরবর্তী বছর তিনি আরণ্যক বিপদ-আপদ থেকে গ্রামবাসীকে রক্ষা করেন। অসুং বা উৎসর্গ বেদি তাঁর সম্মানে উত্তোলন করা হয় এবং তাঁর নাম করে শয়তান তাড়ানো হয়। কালকামের আত্মার খুশির জন্য তাঁর পূজায় একটি ছাগল অথবা একটি মোরগ-মুরগি উৎসর্গ করা হয়। উৎসর্গ বেদিরূপ প্রস্তরে তাঁর পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং উৎসর্গীকৃত পশু বা মোরগ-মুরগির রক্তে ওই প্রস্তর রঞ্জিত করা হয়। জীবনরক্ষাকারী দেবতা হিসেবে তাঁর পূজা অন্য দেবতাদের পূজা অপেক্ষা অধিকতর গুরুত্ব লাভ করে।
৭. সুসিমি (Susime) : সুসিমি হচ্ছে ধন-সম্পদের দেবী। একই সঙ্গে অন্ধত্বের কারণ এবং অশিক্ষা থেকে মুক্তির দেবী। তিনি চন্দ্রদেবের প্রতিনিধি। একটা শূকর, একটি পেঁচা এবং কিছু মদ দিয়ে তাঁর পূজা সম্পন্ন করার বিধান আছে। পূজার উপকরণগুলো অরণ্যচারী গারোদের কাছে সহজলভ্য এবং এগুলো নির্বাচন দেবতার কর্মের সঙ্গেই সংগতিপূর্ণ।
৮. আসিমা ডিনসিমা (Asima Dinsima) : আসিমা ডিনসিম, সুসিমির মাতা। তিনি সুনির্দিষ্ট কোনো কর্ম উপলক্ষে আবির্ভূত হন না। তাঁর পূজাও অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায় না। কিন্তু এ রকম কুসংস্কার চালু রয়েছে যে তাঁর নাম উচ্চারণ করা অতি দুর্ভাগ্যের বিষয়। আপাতদৃষ্টে এ রকম ধারণা করা হয় যে সুসিমি তা সহ্য করতে পারে না। তাঁর অনেক নাম রয়েছে- তন্মধ্যে Norekbak, Norekdim, Sonakalie-Kaburanche and Mikrongitok-kishang-sitok.
৯. নাওয়ান (Nawang) : নাওয়ান হচ্ছে একটি খারাপ আত্মা, যে স্বর্গের পথ থেকে মানুষের আত্মাকে বিতাড়িত করে। একই সঙ্গে জীবিত মানুষকেও খারাপ পথে পরিচালিত করার জন্য সারা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ায়। এ কাজে সে কখনো মনুষ্যরূপে কখনো বা মালডনগং নামক একটি পৌরাণিক প্রাণীর আকৃতিতে ঘুরে বেড়ায়। একই সঙ্গে সে মানুষের পাকস্থলীর ব্যথার কারণ। বমি ও ডায়রিয়া তাঁর ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে। প্রায়ই সে মানুষের মৃত্যুশয্যায় বসে থাকে মৃত্যুর পর তার আত্মাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মরণশীল মানুষ তাঁর আক্রোশ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে লোহার তৈরি একটি অস্ত্র বানিয়ে রাখে। কিন্তু দুষ্ট দেবী মানুষের কাছ থেকে এটা ধার করে নিয়ে যায় এবং দূর থেকে তা নিক্ষেপ করে।
অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে মানুষ আদিকাল থেকেই একটি নিরাপদ আশ্রয়ের অন্বেষায় সংগ্রামরত। শান্তি, নিরাপত্তা, নীরোগ স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের আকাঙ্ক্ষায়ই মানুষ দেবতাকে আবিষ্কার করেছে। তাই তো জীবনের একেকটা দায়িত্ব একেক দেবতাকে অর্পণ করে নিশ্চিত হতে চেয়েছে মানুষ। গারো জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এই প্রবণতা লক্ষণীয়। ফলে উল্লিখিত দেবতা ছাড়া জীবনের অন্যান্য বিষয় ও দিকের নিয়ন্তারূপে আরো অসংখ্য দেবদেবীকে শনাক্ত করেছে এবং পূজা করে যাচ্ছে। এসব বিশ্বাস প্রায়ই যুক্তিহীন আবার কোথাও বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিলভ্যও। বহুদেবত্ববাদে বিশ্বাসী গারোদের সংস্কৃতির বিস্তৃত পরিসরজুড়ে আছে উল্লিখিত দেব-দেবীকে নিবেদিত কৃত্য। সব কৃত্যের সমাচারই তাদের জীবন ও সংস্কৃতি।
একেক দেবতার মর্জি একেক রূপ। তাঁদের খুশি করার রীতিও ভিন্ন ভিন্ন। ভিন্ন ভিন্ন তাঁদের উপাচার, মন্ত্র এবং দিনক্ষণ পূজার লগ্ন। কৃত্যের বাঁধা ছকে আবদ্ধ জীবন তাই কৃত্যসর্বস্ব। ফলে এরূপ নৃগোষ্ঠীর প্রকৃত পরিচয়টি বিধৃত হয় তার Ritual-এর অবয়বে।
গারো সমাজে তাদের ধর্মবোধ বা বিশ্বাসের বিভিন্ন সময়ে নানা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সর্বপ্রাণবাদী গারোরা জন্মান্তর বা আত্মার অবিনশ্বরতায় বিশ্বাসী- এ কথা আগেই বলা হয়েছে। স্বর্গের সুখ বা নরকের কষ্ট-যন্ত্রণা সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। তবে আত্মার চিরন্তন আবাসভূমি যে এক অজ্ঞাত স্থানে এবং তা যে অনাবিল শান্তিময়, তা তারা বিশ্বাস করে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গারোদের পার্থিব জীবনেও নানা পরিবর্তন এসেছে এবং অবধারিতভাবেই সেই পরিবর্তন তাদের ধর্মচিন্তা ও বিশ্বাসকেও করেছে প্রভাবিত।

দৈনিক কালের কন্ঠের ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হারুন রশিদ এর লেখাটি ভালো লাগাতে সংগ্রহ করে রাখলাম।

মন্তব্য করুন