সেন্ট নিকোলাস টলেন্টিনোর গির্জা


aaঢাকার অদূরে অবস্থিত গাজীপুরের গুরুত্ব স্যাটেলাইট টাউন হিসেবে সর্বাধিক। বিশেষ করে সময়ের আবর্তে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এখানে অবস্থিত। পাশাপাশি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ এবং আইআইটির অবস্থান একে দিয়েছে শিক্ষানগরীর সম্মান। তবে হাজার বছরের প্রাচীন নগরী ঢাকার উপকণ্ঠে অবস্থিত এ নগরীর প্রত্ন-ঐতিহ্যকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। অন্তত জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ী ও ভাওয়াল রাজ শ্মশানেশ্বরী, শ্রীপুরের ইন্দ্রাকপুর, কাপাসিয়ার টোক বাদশাহী মসজিদ, পূবাইল জমিদার বাড়ি, কালিয়াকৈরের বলিয়াদি জমিদার বাড়ি, একডালা দুর্গ, টঙ্গীর মীর জুমলা সেতুর পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রথম খ্রিস্ট ধর্মীয় উপাসনা স্থান সেন্ট নিকোলাস টলেন্টিনো চার্চের উপস্থিতি একে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নঘেরা নুহাশ পল্লী, চান্দনার নাগবাড়ী, আনসার একাডেমি, ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান আর বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক এ শহরকে করেছে পর্যটন বিকাশের এক অপার সুযোগ।

গাজীপুরে সবগুলো স্থাপনার তুলনায় নাগরীতে অবস্থিত সেন্ট নিকোলাস টলেন্টিনোর গির্জা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এর নির্মাণকাল বিবেচনায়। সেখানকার দেয়ালে খোদিত সময়কাল বলছে এটি আনুমানিক ১৬৬৩ সালে নির্মিত হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমান নির্মাণ তারিখ হিসেবে সেখানকার দেয়ালে লেখা ১৮৮৮ সালের কথা। নতুন করে নির্মাণের পর বর্তমান সুদৃশ্য গির্জাটি দেখে অনেকের ভিরমি খাওয়ার দশা হতে পারে। দর্শক বলে বসতে পারেন, এত সুন্দর আধুনিক ধাঁচের গির্জাটি কীভাবে বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন গির্জা হতে পারে? তবে এর পূর্বদিকে ফ্যাসেডের এলিভেশনে লেখা ১৬৬৩ সালে নির্মিত হওয়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন অ্যানুরিও দা আর্কদিওসেসে দ্য গোয়া। তিনি এর নির্মাণ সময় হিসেবে দাবি করেছেন ১৬৬৪ সালকে। এর নির্মাণ সময়কাল নিয়ে আরো অনেক বিভ্রান্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত এতটুকু নিশ্চিত হওয়া যায় যে, বর্তমান স্থাপনাটি যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তা অতি প্রাচীন। আর ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে বাংলাদেশের অনেক ঔপনিবেশিক স্থাপনার মতো ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছিল সেন্ট নিকোলাস টলেন্টিনো চার্চও। এক্ষেত্রে যে যা-ই বলুক, চার্চটির ফ্যাসেডে উত্কীর্ণ সময়কালটি শুধু এ চার্চ স্থাপনই নয়, বরং এ অঞ্চলে খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরুর প্রতিও ইঙ্গিত করে।

স্থানীয় উপকথায় গির্জাটির প্রতিষ্ঠালগ্নের কিছু ইতিহাস পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা স্থানে চার্চ প্রতিষ্ঠা ও ধর্মান্তরের অতি কথনগুলোর যে সমস্যা, তা থেকে মুক্ত নয় এ চার্চ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের জনৈক অ্যান্থনির ইতিকথাও। প্রচলিত মিথ বলছে, ভূষণা বিখ্যাত এক হিন্দু জমিদারের পুত্র খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন, নাম নেন অ্যান্থনি। তার সঙ্গে আরো অনেকে সে সময়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। এদের হাত ধরেই গড়ে ওঠে এ চার্চ। এক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে অনেক হিন্দুকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়। তারাই ১৭ শতকের দিকে এ এলাকায় খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কাজটা করেছিলেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখনকার যে পুরনো চার্চ ভবনটি চোখে পড়ে, তার টিকে থাকা অংশাবশেষের ভিত্তিপ্রস্তর ওখানে স্থাপিত হয় ১৭ শতকে। তবে ইটের কাঠামোটি নির্মাণের আগে সেখানে একটি খড়ের চালাঘর দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল গির্জাটি। তবে এখানকার অল্টারে যে খড়ের চালা ছিল, তা ১৮৮১ সালের দিকে পুরোপুরি পুড়ে যায়। অন্যদিকে বর্তমান ইটের তৈরি স্থাপনাটি তৈরি করা হয়েছিল ঠিক ওই সময়ের যে ভিত্তি, তার উপরেই। এতে এর স্থাপিত হওয়ার সময়কাল হিসেবে প্রথমে উল্লিখিত সংখ্যাটিকে অক্ষুণ্ন রাখা যায় বৈকি!

গির্জাটির স্থাপত্য পরিকল্পনায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফিচার লক্ষ করা যায়। তার মধ্যে রয়েছে বারান্দাযুক্ত প্রবেশপথ; ২. সমবেত উপাসনার নিমিত্তে কক্ষ এবং বেদি ও একান্ত প্রার্থনা কক্ষ। তবে সেন্ট নিকোলাস টলেন্টিনো চার্চে চিরাচরিত নার্দেক্স এর পরিবর্তে এ বাংলা ঘরের অনুকরণে চারটি মজবুত খুঁটির ওপর সমতল ছাদযুক্ত একটি বারান্দা তৈরি করা হয়েছে। এটা ইউরোপীয় গির্জা স্থাপত্যের দেশী চরিত্র হিসেবেও ধরা যেতে পারে। আর এর পেছনে কারণটা বোধ হয় কারিগর স্বল্পতা কিংবা এ দেশীয় প্রভাব। এখানে খ্রিস্টীয় ধর্মাধিষ্ঠান তৈরির পেছনে ইউরোপীয় দর্শন কাজ করেছে ঠিকই, কিন্তু যারা এর নির্মাতা তারা এ দেশী।

স্থানীয় নির্মাতারা দেশীয় কাঁচামালে গির্জা তৈরি করতে গিয়ে হয়তো চেয়েছে স্থাপত্যটি গড়ে উঠুক এ দেশীয় স্টাইলেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের চাহিদা সামনে রেখে কাজ করতে গিয়ে হয়তো দুই দেশীয় রীতি মিলেমিশে একাকার হয়েছে। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, এর বারান্দা দিয়ে তিনটি দরজার সাহায্যে একটি হলঘরে প্রবেশ করা সম্ভব। অনেকটা রেললাইনের মতো বারোটি লোহার খাম্বা রয়েছে সেখানে। এগুলো স্তম্ভাকারে ফাঁকা স্থানের ওপর নির্মিত ছাদটিকে ধারণ করেছে। এর সঙ্গে অনেকটা তেজগাঁও গির্জার মিল রয়েছে, যা আইল ও নেভের ভেদকারী অবলম্বন হিসেবে কাজ করছে এ গির্জায়।

গির্জার এন্ট্রি স্পেস তথা প্রবেশ পথ মূলত সামনের দিকের বারান্দা হিসেবে কাজ করে। এটার উপরের ছাদ নির্মিত হয়েছে ছয়টি অষ্টকোণাকৃতির সেমি-গথিক স্তম্ভে ভিত্তি করে। এ খানে তিনটি সেমি-সার্কুলার প্রবেশ পথও রয়েছে। খ্রিস্টীয় ধর্মাধিষ্ঠানে নার্থেক্স তৈরির ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল না রেখে এক্ষেত্রে নার্থেক্স তৈরি হয়েছে অনেকটাই দেশীয় স্টাইলে, যেখানে চার্চ স্থাপত্যের সঙ্গে স্থানীয় কুঁড়েঘর ধারার নির্মাণশৈলীর একটা ফিউশন লক্ষ করা যায় সহজেই। অন্যদিকে বারান্দা দিয়ে নেভে প্রবেশ করা যায়। এক্ষেত্রে একটি বৃহদাকৃতির অবলং হল ঘর রয়েছে, যা বারোটা স্তম্ভের ওপর অবস্থিত। এখানে থাকা রেললাইনের মতো স্তম্ভগুলোই একে আইল ও নেভে বিভক্ত করেছে। এ হলঘরের কোনার দিকে একটা সিঁড়ি ছিল বলে মনে করা হয়। এটা সামান্য কিছু চিহ্ন রেখে এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলা যায়। এখানে একান্ত প্রার্থনা কক্ষ অল্টারের সঙ্গে সংযুক্ত, যেখানে একটি লেন্স আকৃতির খিলানপথ দিয়ে প্রবেশ করা যায়। তবে এ খিলানপথ তুলনামূলকভাবে অনেক অপরিসর ও ঘিঞ্জি আকৃতির বলেই মনে হয়। আয়তাকার এ চার্চ স্থাপত্যটি অনেকটাই উত্তর-দক্ষিণ ডিরেকশনে তৈরি, যেখানে উত্তরেই এর প্রবেশমুখ লক্ষ করা যায়।

দেশী-বিদেশী রীতির মিশ্রণে তৈরি এ গির্জায় রয়েছে মোট চারটি প্রবেশপথ। এর প্রথম তিনটি প্রবেশপথ রয়েছে বারান্দা দিয়ে ঢোকার অবলম্বন হিসেবে উত্তর দিকে। তবে দক্ষিণ দিকে একান্ত প্রার্থনা কক্ষে প্রবেশের জন্যও রয়েছে আরেকটি প্রবেশপথ, যেটি আবার খিলান দিয়ে অলঙ্কৃত। এ প্রবেশপথগুলো বাদ দিলেও এর পূর্ব ও পশ্চিমে মোট ছয়টি করে বারোটি উন্মুক্ত জানালা রয়েছে। এর থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে, সেন্ট নিকোলাস টলেন্টিনো চার্চ তৈরির সময় ভারত উপমহাদেশ তথা বাংলার উষ্ণ আর্দ্র প্রকৃতির কথা মাথায় রেখেই স্থাপত্য পরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়। এখানে এতগুলো জানালা রাখার একটাই কারণ। তা হচ্ছে— বাইরে থেকে বায়ু চলাচলের সুযোগ নিশ্চিত করা।

গির্জাটির ফ্যাসেড ট্রিটমেন্ট ও অলঙ্করণের ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায় বিশেষ বৈচিত্র্য। এর পোর্চ বে নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে চারটি অষ্টকোণী স্তম্ভ। আর হলঘরে প্রবেশের তিনটি সেমি সার্কুলার খিলানপথের কথা আগেই বলা হয়েছে। এগুলোর চারপাশে বেশ সুন্দর অলঙ্করণ লক্ষ করা গেছে। এর ওপর রয়েছে একটি সুদৃশ্য ক্রুশ ও ঘণ্টা যা বিশেষ ধরনের গথিক খিলানের মধ্যে প্রোথিত। খিলানাকৃতির প্রবেশ পথের স্প্যানড্রেল, দরজার উপরিভাগ ও জানালার উপরের অংশ জালি অলঙ্করণে সুশোভিত। পূর্ব ও পশ্চিমের প্রতিটি জানালাতেই সুদৃশ্য অলঙ্করণ লক্ষ করা যায়। পুরো স্থাপত্যটির ওপর যে প্যারাপেট, সেখানে রয়েছে কণিক আকৃতির কিয়স্ক বা ছত্রী। অন্যদিকে গির্জার উত্তর-পশ্চিম কোণে গ্রট্টো অবস্থিত।

আমরা জানি, ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষকে মসলা ও মসলিনের দেশ হিসেবে মনে করত। উসমানীয় সাম্রাজ্য প্রসারিত হওয়ার প্রেক্ষিতে ইউরোপীয়দের জন্য ভূমধ্যসাগর অনেকটা দুর্গম হয়ে যায়। তার পরিপ্রেক্ষিতে এ আরব বণিকদের কারো একজনের সহায়তা নিয়েই ১৪৯৮ সালে ভাস্কো-দা-গামার নেতৃত্বে পর্তুগিজরা পা রাখে ভারতের মাটিতে। অনেকটা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যেই পর্তুগিজরা ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার প্রধান সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রামে আসে। দৈনিক বণিক বার্তার ম্যাগাজিন সিল্ক রুটের একটি সংখ্যার প্রধান রচনা ‘বাংলা ভূখণ্ডে পর্তুগিজ’ শীর্ষক আলোচনায় এ নিয়ে বিস্তৃত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বণিক ও উপনিবেশিকদের সঙ্গে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকরা স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এ দেশে এসেছিলেন। কেউ কেউ বলে থাকেন ‘যেখানেই পর্তুগিজ জাহাজের কাপ্তান গিয়ে তাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন, ঠিক সেখানেই পর্তুগিজ যাজক খ্রিস্টের ক্রুশ স্থাপন করে’। একটি খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক সংঘ ফাদার ফ্রান্সিসকো ফার্নান্দেজ এবং ডমিনিক-দ্য-সুওজা নামক দুজন জেসুইট যাজককে এই উদ্দেশ্যে ১৫৯৮ সালে চট্টগ্রাম প্রেরণ করে।

বিক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা গেছে, পর্তুগিজরা আরাকান রাজ্যের দুঃসময়ে তাদের সাহায্য করে। বলতে গেলে, তার পুরস্কার হিসেবেই আরাকানের রাজা তাদের একটি গির্জা নির্মাণের সুযোগ দেন এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। এ সময় ১৫৯৯ সালে ফাদার ফ্রান্সিসকো ফার্নান্দেজ প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, হুগলি ও চট্টগ্রামে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫ হাজার ও আড়াই হাজারের বেশি কিংবা কাছাকাছি। প্রথম দিকে পর্তুগিজদের ধর্ম প্রচার অনুকূল পরিবেশে শুরু হলেও পর্তুগিজ ও হার্মান দস্যুদের দোসর হিসেবে পাদ্রিরা আত্মপ্রকাশ করায় তা ব্যাহত হয়। বিশেষ করে ১৬০২ সালের দিকে আরাকান পর্তুগিজ দ্বন্দ্বের কারণে তা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দস্যুদের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে এবং তাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করার কারণে পর্তুগিজ গির্জাগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয় এ সময়। তার পর দস্যুদের সঙ্গে যোগসূত্র রাখার অভিযোগে তাদের দুজন ধর্ম প্রচারককে কারাদণ্ডও দেয়া হয়। তখন ফাদার ফার্নান্দেজ কারাগারেই মৃত্যুবরণ করলে দুর্দিন নেমে আসে পর্তুগিজ ধর্ম প্রচারকদের জীবনে।

বাংলার দক্ষিণে সন্দ্বীপ তখন পর্তুগিজদের অধীনে ছিল। ধর্ম প্রচারকরাও সহজে সেখানে তাদের প্রচার কার্য সম্প্রসারিত করে। এতে ভয় পেয়ে রাজা ১৬০৭ সালে দ্বিতীয় দফা তাদের ওপর চড়াও হন। এর ফলে ধর্ম প্রচারকরা মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন হয়। পরবর্তীকালে ১৬২১ সালে অগাস্টিনীয়রা চট্টগ্রামে আসে। এর পর ১৬২১ থেকে ১৬২৪ সালের মধ্যে পর্তুগিজদের ২৮ হাজার দাসকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দেয়। ১৬৭০ সালের কাছাকাছি সময়ে ডম এন্টোনিয় রোজারিও নামের এক সম্ভ্রান্ত বাঙালি ঢাকা, নাগরী ও শ্রীপুর এলাকায় ধর্ম প্রচার চালিয়ে যায় এবং ২০ হাজার হিন্দুকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করে। এ সময়েই নির্মিত হয়েছিল সেন্ট নিকোলাস টলেন্টিনো চার্চ। পরে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৫-১৬২৭) ১৬০৮ সালে ঢাকা নতুন করে বাংলার রাজধানী হলে তা বিভিন্ন দেশের বণিক ও ব্যবসায়ীকে আকৃষ্ট করে। তখনকার বর্ধিত মুসলিম সমাজের বাইরে গাজীপুর খ্রিস্টধর্ম বিকাশের একটি নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়, যা অনেকাংশে নির্ধারণ করে দেয় সেন্ট নিকোলাস টলেন্টিনো চার্চ বিকাশের পথ।

বাংলাদেশের প্রাথমিক পর্যায়ে নির্মিত গির্জার ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিদেশী নির্মাণশৈলী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ধীরে ধীরে তা স্থানীয় প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নতুন অথবা শংকর রূপ ধারণ করে। বিষয়টির সমালোচনামূলক পর্যবেক্ষণের জন্য এ দেশে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের পটভূমি, স্থানীয় রীতিনীতি, নির্মাণ পদ্ধতি এবং নির্মাণসামগ্রী, জলবায়ু, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। আমরা জানি, অসংখ্য নদীবিধৌত ব-দ্বীপের দেশ বাংলাদেশ। এখানকার পরিবেশ মিশ্র অথবা মৌসুমি জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত। আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাত এখানকার জলবায়ুর প্রধান উপাদান, যা প্রত্যক্ষভাবে দেশীয় স্থাপত্য রীতিকে প্রভাবিত করে। তুলনামূলকভাবে উচ্চমাত্রার আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতের কারণে এখানকার কক্ষ পরিকল্পনায় আড়াআড়ি বায়ু চলাচল ও বৃষ্টি প্রতিরোধক ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন রয়েছে। বলতে গেলে, এখানকার গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ এবং শীতে উত্তর থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়। তাই ঘর তৈরির ক্ষেত্রে যে আয়তাকৃতিকে গুরুত্ব দেয়া হয়, সেন্ট নিকোলাস টলেন্টিনো চার্চে সেটাই স্পষ্ট হয়েছে।

একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এর বৃহত্তর দিক পূর্ব-পশ্চিম অক্ষ বরাবর রাখা হয়েছে। পাশাপাশি আড়াআড়ি বায়ু চলাচলের জন্য উত্তর ও দক্ষিণ দিক খোলাও রাখা হয়েছে। আমাদের মেনে নিতেই হবে বাংলার দেশজ স্থাপত্য রীতি ও নির্মাণ উপাদানগুলো সেন্ট নিকোলাস টলেন্টিনো গির্জার স্থাপত্যশৈলীকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। তবে এর প্রধান নির্মাণ উপাদান হিসেবে ইটই ব্যবহূত হয়েছে। দেয়াল নির্মাণের একমাত্র উপকরণ রূপে ইটের ব্যবহারের পাশাপাশি গির্জা নির্মাণের ক্ষেত্রে ট্র্যাবিয়েট পদ্ধতি অনুসৃত। তবে এর হয়ে ছাদ নির্মাণে আনুভূমিক তীর, বর্গা ও উল-ম্ব স্তম্ভ ব্যবহূত হতে দেখা যায়। পাশাপাশি খিলান, টারেট, কার্নিশ এবং পলেস্তরাকৃত সমতল দেয়ায়ে রয়েছে নানা ধরনের জ্যামিতিক নকশা। সব মিলিয়ে বাংলায় নির্মিত প্রাক-ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের একটি অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন সেন্ট নিকোলাস টলেন্টিনোর গির্জা। ধীরে ধীরে রাজধানীর উপকণ্ঠে অবস্থিত গাজীপুর অঞ্চলে পর্যটন বিকাশ ঘটলে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে এই গির্জাও।

মন্তব্য করুন